দাবায়ে রাখতে পারবা না, পারেনি।
সম্পাদকীয়
এডভোকেট মোহাম্মদ এনামুল হক, আদালত বার্তাঃ২৩ডিসেম্বর ২০২৩।
বঙ্গবন্ধু স্বদেশ প্রত্যাবর্তন দিবসে দাবায়ে রাখতে না পারার কথা বলেছেন তিনবার। ৭ মার্চের ভাষণে বলেছেন দুবার। ব্যাপারটা তাৎপর্যপূর্ণ ও গভীরতর চিন্তার দাবি রাখে। জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের স্বদেশ প্রত্যাবর্তন এবং সেদিনের সেই ভাষণ পৌঁছালো পঞ্চাশে। বঙ্গবন্ধুর দর্শনকে বুঝতে হলে তাঁর জীবন-কর্ম ও ভাষণকে বোঝাটা জরুরি। বঙ্গবন্ধু সারা জীবনের ভাষণগুলোর মধ্যে সংক্ষিপ্ত ভাষণ সম্ভবত এটি, এবং সেটা তিনি দিয়েছেন অসুস্থ অবস্থায় এবং সেটা স্পষ্টও করেছেন। তিনি যেমন বলেছেন আজ আমি কথা বলতে পারবো না, আবার বলেছেন আমি সুস্থ হয়ে নিই তারপর কথা বলবো। তারপরও আমরা বিস্ময়ের সঙ্গে লক্ষ করি, বঙ্গবন্ধুর এই ভাষণ নানাভাবে গুরুত্ববহ। এই লেখায় ‘দাবায়ে রাখতে পারবা না’, পারিনি- বিষয়টা জারি রাখা হবে বঙ্গবন্ধুর স্বদেশ প্রত্যাবর্তন দিবসের ভাষণের আলোকে।
বঙ্গবন্ধুর ‘দাবায়ে রাখতে পারবা না’ অমেয়বাণীর আগ্রহোদ্দীপক ও চিত্তাকর্ষক এক মূল্যায়ন করেছেন সাহিত্যিক-চিন্তক আহমদ ছফা। তিনি বলছেন, ‘‘বাঙালির শ্রেষ্ঠ কাব্য ‘বলাকা’ নয়, ‘সোনার তরী’ নয়, বাঙালির শ্রেষ্ঠ কাব্য ‘আর দাবায়ে রাখতে পারবা না’।
বাস্তবিকই তাই। হাজার বছরের বাঙালির দৃঢ়তার চূড়ান্তরূপ, যা আমরা পেয়েছি বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণে। যেখানে তিনি বলেছেন, ‘তোমরা আমার ভাই, তোমরা ব্যারাকে থাকো, কেউ কিছু বলবে না। গুলি চালালে আর ভালো হবে না। সাত কোটি মানুষকে আর দাবায়ে রাখতে পারবা না। বাঙালি মরতে শিখেছে, তাদের কেউ দাবাতে পারবে না।’
বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণ যেমন একটা পরাধীন জাতির জন্য, স্বাধীনতার দৃপ্ত শপথে উজ্জীবিত হওয়ার বীজমন্ত্র, তেমনি ১০ জানুয়ারির ভাষণ ছিল সদ্য স্বাধীন একটা দেশের জন্য আলোকবর্তিকা। দুটো ভাষণেই বঙ্গবন্ধুর দৃঢ়তা উন্মোচিত হয়েছে হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালির সংহত স্বরূপে।
বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, ‘দাবায়ে রাখতে পারবা না।’ বাস্তবে ঘটেছেও তা-ই। বাঙালিকে দাবায়ে রাখতে পারিনি। ১৯৭১ সালে সেটা যেমন সত্যে পরিণত হয়েছে, স্বাধীন-সার্বভৌম এক ‘বাংলাদেশ’ হিসেবে বিশ্ব মানচিত্রে আত্মপ্রকাশের মধ্য দিয়ে। অর্ধশত বছর পর ২০২১ এসেও সেই সত্যই প্রতিভাত হচ্ছে, নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মা সেতুর মতো বিস্ময় জাগানিয়া বিশ্বমানের সেতুকাঠামো স্থাপন করে।
স্বদেশ প্রত্যাবর্তন দিবসের ভাষণের তিনটা জায়গায় বঙ্গবন্ধু প্রাসঙ্গিকতার সঙ্গে যৌক্তিকভাবে ‘দাবায়ে রাখতে পারবা না’ প্রসঙ্গে বলেছেন–
০১ ‘আমার বাংলাদেশ আজ স্বাধীন হয়েছে, আমার জীবনের সাধ আজ পূর্ণ হয়েছে, আমার বাংলার মানুষ আজ মুক্ত হয়েছে। আমি আজ বক্তৃতা করতে পারবো না। বাংলার ছেলেরা, বাংলার মায়েরা, বাংলার কৃষক, বাংলার শ্রমিক, বাংলার বুদ্ধিজীবী যেভাবে সংগ্রাম করেছে, আমি কারাগারে বন্দি ছিলাম, ফাঁসিকাষ্ঠে যাবার জন্য প্রস্তুত ছিলাম কিন্তু আমি জানতাম আমার বাঙালিকে দাবায়ে রাখতে পারবে না।’
০২. তবে মনে রাখা উচিত, বাংলাদেশ স্বাধীন রাষ্ট্র। বাংলাদেশ স্বাধীন থাকবে বাংলাদেশকে কেউ দমাতে পারবে না। বাংলাদেশকে নিয়ে ষড়যন্ত্র করে লাভ নাই।
০৩. ‘‘কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ বলেছিলেন, ‘সাত কোটি বাঙালির হে মুগ্ধ জননী, রেখেছো বাঙালি করে মানুষ করোনি’। ‘কবিগুরুর কথা আজ মিথ্যা প্রমাণ হয়ে গেছে। আমার বাঙালি আজ মানুষ। আমার বাঙালি আজ দেখিয়ে দিয়েছে দুনিয়ার ইতিহাসে এত লোক আত্মাহুতি, এত লোক জান দেয় নাই। তাই আমি বলি আমায় দাবায়ে রাখতে পারবা না।’
লক্ষণীয়, দাবায়ে, দমাতে, দাবায় শব্দ তিনটি বঙ্গবন্ধু আলটপকা বলেননি। তিনি ইতিহাস ও ঐতিহ্যের পরম্পরা যেমন টেনেছেন, তেমনই সেই সময়ের বাস্তবতার প্রেক্ষাপটে সদ্য স্বাধীনতাপ্রাপ্ত একটা দেশের করণীয় ও বৈশ্বিকতাকে মোকাবিলা এবং সহযোগে পরিণত করার পথ ও পন্থা কেমন হবে তা বোঝাতে আশ্রয় নিয়েছেন ওই শব্দচয়নে এবং বাক্যের ব্যবহারে।
৭ মার্চের ভাষণের যেমন চাবিকাঠি ছিল দাবায়ে রাখতে পারবা না, তেমনই স্বদেশ প্রত্যাবর্তন দিবসেরও। কারণ প্রেক্ষাপট ও পরিপ্রেক্ষিত দুই সময় ও ভূগোলের বাস্তবতা হলেও গূঢ় ও প্রধানতম বিষয় ছিল এক ও অভিন্ন, সেটা হলো একটা জাতির নিজস্ব পরিচয়ে স্বাধীন দেশের মানুষ হিসেবে আত্মপ্রকাশ ও অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার লড়াই। বঙ্গবন্ধু জানতেন স্বাধীনতা অর্জন যেমন কঠিন, তার চেয়েও অধিক কঠিন হলো স্বাধীনতা রক্ষা করা। পুরো ভাষণের দিকে যদি আমরা খেয়াল করি, তাহলে দেখব সেখানে শত কথা বলা হলেও আসলে বলা হয়েছে একটা কথা, চার শব্দে এক বাক্যে, ‘দাবায়ে রাখতে পারবা না।
স্বদেশ প্রত্যাবর্তন দিবসের ভাষণ প্রসঙ্গে আবুল বারকাত বলছেন, ‘বঙ্গবন্ধুর স্বদেশ-প্রত্যাবর্তন ভাষণের প্রতিটি শব্দ-বাক্য গভীর অন্তর্দৃষ্টিসম্পন্ন এবং বাংলাদেশের স্বাধীনতার প্রকৃত ভিত্তি সৃষ্টি ও তা সুদৃঢ়করণ উদ্দিষ্ট স্পষ্ট পথনির্দেশ। বঙ্গবন্ধুর বিশ্বদৃষ্টিভঙ্গি, জীবনদর্শন, রাষ্ট্রচিন্তা, সমাজ ভাবনা, রাজনীতি চিন্তা ও অর্থনৈতিক উন্নয়ন ভাবনার পরস্পর সম্পর্কিত এক সমগ্রক রূপ (holistic form)-এ ভাষণে স্পষ্ট প্রতিভাত।’
বঙ্গবন্ধুর স্বদেশ প্রত্যাবর্তন দিবসের ভাষণে মুখ্যত সাতটা বিষয় স্পষ্ট হয়েছে।
০১. জনগণ, জাতীয়তাবাদ ও স্বাধীনতা;
০২. ভারত, ইন্দিরা গান্ধী, ভারতীয় সৈন্য;
০৩. পাকিস্তান, ভুট্টো, পাকহানাদার বাহিনী;
০৪. বিশ্বদৃষ্টিভঙ্গি, জাতিসংঘ;
০৫. কেমন বাংলাদেশ চাই;
০৬. রবীন্দ্রনাথ;
০৭. দৃঢ়তা।
ভাষণটা পাঠ করলে আমরা বুঝতে পারবো বঙ্গবন্ধু এসব বিষয়ে কতটা স্পষ্ট করে নিজের মতামত উপস্থাপন করেছেন এবং যার যা প্রাপ্য তা যেমন দিতে কার্পণ্য করেননি তেমনি কাকে কী বলতে হবে এবং কার সঙ্গে কী হবে সেই বিষয়েও করলেন খোলতাই এবং সুনির্দিষ্ট। কিন্তু এসবের সবই মিলিত হয়েছে এক লক্ষ্যে আর সেটাকে আমরা ‘দৃঢ়তা ’ হিসেবে করেছি চিহ্নিত ও সংজ্ঞায়িত। দৃঢ়তার অপর নামকে আমরা বলতে চাই, দাবায়ে রাখতে পারবা না।
বাঙালিকে সত্যিই দাবায়ে রাখা যায়নি, বাঙালির স্বাধীনতার লড়াই ও মুক্তির সংগ্রামকে আটকানো যায়নি, নানামুখী ষড়যন্ত্রের পরও। কারণ, বাঙালির ছিলেন একজন বঙ্গবন্ধু। আহমদ ছফার মূল্যায়ন বুঝি তাই সঙ্গত কারণেই এরকম, ‘আজ থেকে অনেকদিন পরে হয়তো কোনও পিতা তাঁর শিশুপুত্রকে বলবেন, জান খোকা! আমাদের দেশে একজন মানুষ জন্ম নিয়েছিল, যাঁর দৃঢ়তা ছিল, তেজ ছিল আর ছিল অসংখ্য দুর্বলতা। কিন্তু মানুষটির হৃদয় ছিল, ভালোবাসতে জানতেন, দিবসের উজ্জ্বল সূর্যালোকে যে বস্তু চিকচিক করে জ্বলে তা হলো মানুষটির সাহস। আর জ্যোৎস্না রাতে রুপালি কিরণধারায় মায়ের স্নেহের মতো যে বস্তু আমাদের অন্তরে শান্তি এবং নিশ্চয়তার বোধ জাগিয়ে তোলে তা হলো তাঁর ভালোবাসা। জান খোকা তাঁর নাম? শেখ মুজিবুর রহমান।’
বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে ১৯৪৭ থেকে ১৯৭১-এর দীর্ঘ ষড়যন্ত্রেও দাবায়ে রাখা যায়নি বাঙালিকে। বঙ্গবন্ধুকেও পাকিস্তানিরা আটকে রাখতে পারেননি, ফাঁসির বন্দোবস্ত করা হয়েছে, কবর খোঁড়া হয়েছে। কিন্তু জয় হয়েছে সত্যের। বাংলাদেশ স্বাধীন হয়েছে, বাঙালি জাতির মুক্তির লড়াই পেয়েছে বিজয়ের পূর্ণতা। স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীতে এসে বঙ্গবন্ধুর সেদিনের সেই দৃঢ়তা হয়েছে আরও বাঙ্ময় ও বাস্তব এক সত্য। পদ্মা সেতুকে নিয়ে কম ষড়যন্ত্র হয়নি। কিন্তু এখানেও সত্যের বিজয় হয়েছে বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনার নেতৃত্বে- বঙ্গবন্ধুর ‘দাবায়ে রাখতে পারবা না’র দৃঢ়তাকে তিনিও লালন করে চলেছেন পরম যত্নে-অসীম সাহসিকতায়।
আমাদের অর্জন এখন ঈর্ষণীয় একথা যেমন সত্য, তেমনই কিছু অপ্রাপ্তিও রয়েছে, ঠারে ঠারে বলা যায় অনেক কথায়। খামতি-খেয়ালিপনা আর অব্যবস্থাপনা অসহনীয়-যন্ত্রণাদগ্ধ-শোচনযোগ্য। কারণ, এখনও সামগ্রিক হয়ে ওঠার যে লড়াই সেখানে আমরা অনেক বেশি ব্যক্তিসর্বস্ব, প্রতিষ্ঠান-সমাজ-রাষ্ট্র কাঠামো পেলেও ব্যক্তিকে পেতে লাগছে আতশি কাচের সাহায্য ও সহায়তা। বঙ্গবন্ধুর দৃঢ়তা কন্যার মাঝেই দীপ্তমান-চর্চিত ও পরিপুষ্ট। কিন্তু অন্যেরা যেন, অমর্ত্য সেনের এই কথার সাক্ষাৎ প্রতিমূর্তি, ‘কীভাবে আমাদের রাজনৈতিক নেতারা কী করতে হবে সে ব্যাপারে বাগাড়ম্বরে ভরা বক্তৃতা দিতে যতটা দড়, সেগুলোকে কাজে পরিণত করতে ততটাই নিষ্কর্মার ঢেঁকি।’
হ্যাঁ, আমাদের উন্নয়ন হচ্ছে, কিন্তু ব্যক্তির সমগ্রতাবোধের অভাব এবং বোধের অপচিকীর্ষা আমাদের অর্জনকে নিয়ে যাচ্ছে সেটা খতিয়ে এবং তলিয়ে দেখা জরুরি ও অবশ্যম্ভাবী। কারণটা বুঝতে অমর্ত্য সেনের দিকে একটু মনোযোগ দেওয়া যেতে পারে বৈকি। তিনি বলেছেন, ‘উন্নয়ন মানে কেবল কিছু বস্তু জড়ো করে যাওয়া বোঝায় না। মোট জাতীয় উৎপাদন, শিল্পের উন্নয়ন বা প্রযুক্তির উন্নতি বা সমাজের আধুনিকীকরণ, এগুলো অবশ্যই মূল্যবান, অনেক সময় অতি গুরুত্বপূর্ণও বটে, কিন্তু এদের মূল্য নির্ভর করে এগুলো মানুষের জীবন এবং স্বাধীনতার জন্য কতটা কী করতে পারলো, তার ওপর। যারা প্রাপ্তবয়স্ক মানুষ, যাদের নিজেদের নির্বাচন অধিকার রয়েছে, তাদের কাছে শেষ অবধি প্রশ্ন এটাই দাঁড়ায় যে, যা তাদের কাছে মূল্যবান তা করার বা পাওয়ার স্বাধীনতা তাদের আদৌ আছে কিনা। এই অর্থে উন্নয়ন মানে মানুষের সক্ষমতার প্রসার।’
দাবায়ে রাখতে পারবা না, পারিনি- এই অর্জনের সুবর্ণজয়ন্তীতে-বঙ্গবন্ধুর শতবর্ষে দাঁড়িয়ে আমরা কেন নিষ্প্রভ-ম্রিয়মাণ-প্রত্যাশার খামতিতে প্রশ্রয় দেবো? বঙ্গবন্ধুর দর্শনের সারাৎসার, ‘দাবায়ে রাখতে পারবা না’, পারিনি-পারছে নাও। কিন্তু বাধাগ্রস্ত করছে যারা তাদের কি আমরা চিহ্নিত ও সংজ্ঞায়িত করবো না, বঙ্গবন্ধুর দর্শনকে যারা বুঝতে অপারগ এবং ধারণে অক্ষম, তাদের কেন লিজ দেওয়া হচ্ছে মোসাহেবির পদ-পদক ও লেবাস-মুখোশের মালিকানা।