রাশিয়া ও ইউক্রেনের মধ্যে সর্বশেষ আলোচনাও ব্যর্থ হয়েছে। ২৪ ঘণ্টার যুদ্ধবিরতি কার্যকরে ইউক্রেনের দাবি রাশিয়া অস্বীকার করেছে। বৃহস্পতিবার তুরস্কে অনুষ্ঠিত বৈঠকের পর ইউক্রেনের পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেছেন, রাশিয়ার দাবি অনুযায়ী তার দেশ আত্মসমর্পণ করবে না। আর রাশিয়ার পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেছেন, ইউক্রেন সংকটের সমাধানে তার দেশ `সিরিয়াস আলোচনা` চায়। তবে বৈঠকে বড় কোনো অগ্রগতি না হলেও মানবিক ইস্যুতে কাজ করতে দুদেশ সম্মত হয়েছে।
অবরুদ্ধ শহরগুলো থেকে বেসামরিক নাগরিকদের বের হওয়ার লক্ষ্যে সাতটি `মানবিক করিডোর` চালু করেছে ইউক্রেন। এছাড়া রাজধানী কিয়েভ রক্ষায় ইউক্রেন সামরিক শক্তি বাড়াচ্ছে। কিয়েভের পথে রুশ বাহিনী এগিয়ে যাওয়ায় ইউক্রেন এ পদক্ষেপ নিয়েছে। কিয়েভের মেয়র বলছেন, প্রায় ২০ লাখ লোক শহরটি ছেড়ে পালিয়ে গেছেনযা রাজধানীর জনসংখ্যার প্রায় অর্ধেক। এদিকে, বুধবার রাতে ইউক্রেনের একটি শহরে শিশু ও মাতৃসদন হাসপাতালে রুশ বোমা হামলায় এক শিশুসহ তিনজন নিহত হয়েছেন।
এ হামলাকে যুদ্ধাপরাধ বলে আখ্যা দিয়েছেন ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট। হামলার নিন্দা জানিয়ে জাতিসংঘের মহাসচিব ঘটনাকে `ভয়াবহ` বলে আখ্যা দিয়েছেন। আর যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপের একের পর এক নিষেধাজ্ঞার জবাবে এবার `বন্ধুত্বপূর্ণ নয়` এমন দেশসমূহে পণ্য রপ্তানি নিষিদ্ধ করেছে রাশিয়া। নিষেধাজ্ঞা দেওয়া হয়েছে রাশিয়ায় বাণিজ্যিক কর্মকাণ্ড পরিচালনাকারী পশ্চিমা কোম্পানিগুলোর ওপরও। খবর বিবিসি, এএফপি, রয়টার্স, দ্য গার্ডিয়ান, আলজাজিরা ও সিএনএনের।
তুরস্কের আন্তালিয়া শহরে বৈঠকের পর ইউক্রেনের পররাষ্ট্রমন্ত্রী দিমিত্রো কুলেবা জানান, এ বৈঠকে কোনো ফলাফল আসেনি। কারণ আমাদের আত্মসমর্পণ করতে আহ্বান জানায় রাশিয়া। যা আমরা কখনো মেনে নেব না। তিনি বলেন যুদ্ধবিরতি, অগ্রাধিকার ভিত্তিতে মারিওপোলে মানবিক করিডোর স্থাপন এবং ২৪ ঘণ্টার জন্য ইউক্রেনে যুদ্ধবিরতি কার্যকরের দাবি জানানো হয়েছিল। কিন্তু এসব বিষয়ে রুশ পররাষ্ট্রমন্ত্রী ইতিবাচক কিছুই বলেননি।
রাশিয়ার পররাষ্ট্রমন্ত্রী সের্গেই ল্যাভরভের সঙ্গে বৈঠকের পর দিমিত্রো কুলেবা বলেন, যুদ্ধ অবসান, মানুষের দুর্দশা লাগব এবং দখলদারিত্ব থেকে ইউক্রেন রক্ষায় আমরা আলোচনা চালিয়ে যেতে প্রস্তুত। সংকট নিরসনে আরও বৈঠক হবে। তিনি আরও বলেন, বৈঠকে বড় কোনো অগ্রগতি না হলেও দুদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রীরা মানবিক ইস্যুতে কাজ করতে সম্মত হয়েছেন। মানবিক করিডোর প্রতিষ্ঠা করার বিষয়ে তারা রাজি হয়েছেন।
ইউক্রেনের উপপ্রধানমন্ত্রী ইরইয়ানা ভেরেশ্চুক জানিয়েছেন, অবরুদ্ধ শহরগুলো থেকে বেসামরিক নাগরিকরা যাতে বের হয়ে যেতে পারেন সে লক্ষ্যে সাতটি `মানবিক করিডোর` শুরু করেছে ইউক্রেন। বেসামরিক নাগরিকদের নিরাপদ চলাচলের সুযোগ দিতে মানবিক করিডোর অঞ্চলে সেনা কার্যক্রম সাময়িকভাবে বন্ধ থাকবে। দক্ষিণপূর্ব অঞ্চলের শহর সুমির আঞ্চলিক গভর্নর জানান, শহর ছাড়তে চাওয়া মানুষ এরইমধ্যে ওই অঞ্চল ছেড়ে বের হতে শুরু করেছেন এবং সেখানে স্থানীয়ভাবে যুদ্ধবিরতি চলছে।
ইউক্রেন ইস্যুতে পশ্চিমাদের আচরণ `বিপজ্জনক` : তুরস্কে বৈঠকের পর সংবাদ সম্মেলনে রুশ পররাষ্ট্রমন্ত্রী সের্গেই ল্যাভরভ অভিযোগ করেন, ইউক্রেন ইস্যুতে `বিপজ্জনক আচরণ` করছে পশ্চিমা দেশগুলো। সতর্ক করে তিনি বলেন, পশ্চিমা শক্তিধর রাষ্ট্রগুলো ইউক্রেনকে প্রাণঘাতী অস্ত্র সরবরাহ করছে। এতে করে ভবিষ্যতে ওই অঞ্চলের নিরাপত্তার ওপর প্রভাব ফেলবে।
পশ্চিমা দেশগুলোর বিরুদ্ধে ল্যাভরভ অভিযোগ করেছেন তারা ইউক্রেনকে অস্ত্র সরবরাহ করে `বিপজ্জনক আচরণ` করছে। এটি `তাদের তথাকথিত নীতি ও মূল্যবোধের বিরুদ্ধে`। তিনি আরও বলেন, রাশিয়ার নিরাপত্তাজনিত উদ্বেগের বিষয়ে `কেউই আমাদের কথা শোনে না।` তিনি দাবি করেন, পূর্ব ইউক্রেনে সম্প্রতি যেসব এলাকা `মুক্ত করা হয়েছে` সেসব এলাকায় কিছু `নতুন তথ্য` পাওয়া গেছে। যা থেকে বোঝা যায়এসব এলাকার ওপর হামলার ব্যাপারে কয়েক মাস ধরেই প্রস্তুতি নেওয়া হয়েছে। তিনি বলেন, জীবাণু অস্ত্র তৈরির জন্য পেন্টাগন ইউক্রেনকে ব্যবহার করছে।
তবে যুক্তরাষ্ট্র এ ধরনের অভিযোগকে `উদ্ভট` বলে উল্লেখ করেছে। ল্যাভরভ বলেন, হোয়াইট হাউজের অস্বীকৃতিতে `বিস্মিত হওয়ার কিছু নেই` এবং ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন এবং জাতিসংঘ বলেছে এরকম কিছু হওয়ার বিষয়ে তাদের কাছে কোনো তথ্যপ্রমাণ নেই। কারণ `গভীর গোপনীয়তার` সঙ্গেই আমেরিকা এসব অস্ত্র তৈরি করছে।
রুশ দৃষ্টিভঙ্গি থেকে যুদ্ধের অগ্রগতি কীএমন প্রশ্নের উত্তরে ল্যাভরভ বলেন, ইউক্রেনে অভিযান একটি `বিশেষ অভিযান`। যা `সার্বিক পরিকল্পনা অনুযায়ী চলছে`। অন্য কোন দেশে রাশিয়ার আক্রমণ করার পরিকল্পনা রয়েছে কিনা এমন প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, রাশিয়া ইউক্রেন আক্রমণ করেনি।
ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদমির জেলেনস্কির সঙ্গে রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন বৈঠক করবেন কিনাএমন প্রশ্নের উত্তরে ল্যাভরভ বলেন, নির্দিষ্ট ইস্যু নিয়ে কথা বলতে জেলেনস্কি রাজি থাকলে পুতিন অবশ্যই কথা বলবেন। নির্দিষ্ট ইস্যু বলতে ল্যাভরভ নিজেদের দাবিগুলোর কথাই বলেছেন। রাশিয়ার দাবি হলোইউক্রেন কখনো ন্যাটোর সদস্য হতে পারবে না। ক্রিমিয়াকে রাশিয়ার অংশ হিসাবে স্বীকৃতি দিতে হবে এবং লুহানস্ক ও দোনেস্ককে স্বাধীন রাষ্ট্র হিসাবে স্বীকৃতি দিতে হবে। ইউক্রেনে রাসায়নিক বা জৈব অস্ত্র রাশিয়া ব্যবহার করতে পারে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন হোয়াইট হাউজের প্রেস সেক্রেটারি জেন সাকি। ইউক্রেনে যুক্তরাষ্ট্র রাসায়নিক অস্ত্র তৈরি করছে এমন অভিযোগে এক টুইট বার্তায় সাকি রাশিয়ার সমালোচনা করেন।
`অলৌকিক কিছু আশা` করা ঠিক নয় : আন্তালিয়া শহরে রাশিয়া ও ইউক্রেনের পররাষ্ট্রমন্ত্রীদের মধ্যে শান্তি আলোচনার পর তুর্কী পররাষ্ট্রমন্ত্রী মেভলুত কাভুসলু বলেন, বৈঠকটিকে `গুরুত্বপূর্ণ সূচনা` বলে অ্যাখায়িত করেছেন। তুরস্কের একটি সংবাদ মাধ্যমকে তিনি বলেন, মাত্র একটি বৈঠক থেকে `অলৌকিক কিছু আশা` করা ঠিক নয়। তিনি আরও বলেন, অনেক অসুবিধা সত্ত্বেও আমি বলব একটি ভালো বৈঠক হয়েছে। আমরা মানবিক করিডোর খোলা রাখার ওপর জোর দিয়েছিলাম। এ যুদ্ধে তুরস্ক নিরপেক্ষ অবস্থান বজায় রাখতে চেষ্টা করছে। কারণ দুটো দেশের সঙ্গেই তাদের কৌশলগত গুরুত্বপূর্ণ সম্পর্ক রয়েছে।
শিশু ও মাতৃসদন হাসপাতালে বোমা হামলা : বুধবার রাতে দক্ষিণাঞ্চলের শহর মারিওপোলের শিশু ও মাতৃসদন হাসপাতালে বোমা হামলায় এক শিশুসহ তিনজন মারা গেছেন। হামলায় ১৭ জন আহত হন। তাদের মধ্যে গর্ভবতী নারীও রয়েছেন। ইউক্রেনের অভিযোগ যুদ্ধবিরতি চলাকালে হাসপাতালটিতে রাশিয়া বোমা হামলা করেছে। শহরের ডেপুটি মেয়র সের্গেই ওরলভ জানান, এ পর্যন্ত শহরের তিনটি হাসপাতাল ধ্বংস করে দেওয়া হয়েছে। তিনি বলেন, আগের দিন ৩০০ শয্যাবিশিষ্ট একটি কোভিড হাসপাতাল ও রক্তের নমুনা সংগ্রহ কেন্দ্রে রুশ বাহিনী আর্টিলারি হামলা চালায়।
রাজধানী কিয়েভ থেকে দেওয়া এক ভিডিও বার্তায় ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কি বলেন, মারিওপোল শহরে যা করা হয়েছে তা সহিংসতার মাত্রা ছাড়িয়ে গেছে। শিশু ও মাতৃসদন হাসপাতালে বোমা হামলা ইউক্রেনে গণহত্যা অব্যাহত থাকার চূড়ান্ত প্রমাণ। তিনি বলেনরাশিয়ান ফেডারেশন কেমন দেশযারা শিশু ও মাতৃসদন হাসপাতালেও ভয় পায় এবং ধ্বংস করে? তিনি প্রশ্ন রাখেনহাসপাতালের কেউ কি রুশ ভাষাভাষীদের ওপর অত্যাচার করেছিল? আজ আমাদের সবার একত্রিত হয়ে রাশিয়ার এ যুদ্ধাপরাধের নিন্দা জানাতে হবে। ইউরোপীয় নাগরিকদের উদ্দেশে ইউক্রেনীয় প্রেসিডেন্ট বলেন, আপনারা বলতে পারবেন না যে, ইউক্রেনে কী ঘটেছে তা দেখেননি, মারিওপোলের বাসিন্দাদের সঙ্গে কী ঘটেছে তা দেখেননি।
নিষেধাজ্ঞার জবাবে পশ্চিমে রপ্তানি নিষিদ্ধ করল রাশিয়া : `বন্ধুত্বপূর্ণ নয়` এমন দেশসমূহে পণ্য রপ্তানি নিষিদ্ধ করে রাশিয়ার প্রধানমন্ত্রী মিখাইল মিশুস্তিন স্বাক্ষরিত এক সরকারি আদেশে বলা হয়েছে, প্রাথমিকভাবে ২০২২ সালের শেষ নাগাদ এই নিষেধাজ্ঞা কার্যকর রাখার সিদ্ধান্ত নিয়েছে দেশটির সরকার। তবে প্রয়োজনে এই মেয়াদ আরও বাড়তে পারে। রপ্তানি নিষেধাজ্ঞা দেওয়া হয়েছে এমন পণ্যের মধ্যে আছে টেলিকম, চিকিৎসাসামগ্রী, কৃষিপণ্য, বৈদ্যুতিক যন্ত্রপাতি ও সরঞ্জাম, গাড়ি, রেলের বগি, কন্টেইনার, টারবাইন ও কাঠ। এ ছাড়া যেসব বিদেশি কোম্পানি রাশিয়া রপ্তানিমুখী পণ্য প্রস্তুত করে, তাদের কর্মকাণ্ডেও স্থগিতাদেশ দেওয়া হয়েছে।
কিয়েভের অর্ধেক লোক পালিয়েছে : ইউক্রেনের রাজধানী কিয়েভের মেয়র ভিতালি ক্লিৎসকো বলেছেন, শহরের প্রতিটি রাস্তা এবং ভবন এখন এক দুর্গে পরিণত হয়েছে। রুশ বাহিনী এখন শহরটির আরো কাছাকাছি চলে