পদ্মা সেতুস্বপ্ন সত্য হওয়ার এক বছর
নিউজ ডেস্ক আদালত বার্তা :২৫ জুন ২০২৩,
এখন আর ঘাটে বসে থাকতে হয় না ঘণ্টার পর ঘণ্টা। এক পদ্মা সেতুতেই বদলে গেছে সব। আজ সেই সেতুর উদ্বোধনের এক বছর পূর্ণ হচ্ছে
এখন আর ঘাটে বসে থাকতে হয় না ঘণ্টার পর ঘণ্টা। এক পদ্মা সেতুতেই বদলে গেছে সব। আজ সেই সেতুর উদ্বোধনের এক বছর পূর্ণ হচ্ছে। ছবি: আজকের পত্রিকা
বছরখানেক আগেও যশোরের ঝিকরগাছার মাছ ব্যবসায়ী মো. মাসুদ ঢাকায় আসতে চাইতেন না। মাছের ট্রাক নিয়ে ঢাকা এসে বিক্রি করে বাড়ি ফিরতে সময় লাগত তিন দিন। সেই মাসুদ গত শুক্রবার সন্ধ্যার পর মাছ নিয়ে রওনা দেন ঢাকার উদ্দেশে। ভোর নাগাদ পৌঁছে যান রাজধানীর কারওয়ান বাজারে। বেলা ১টার মধ্যে মাছ বিক্রি করে টাকাও পেয়ে যান। কিছু কেনাকাটা করে সন্ধ্যা নাগাদ তাঁর আবার বাড়িমুখী হওয়ার কথা ছিল। আশা করছিলেন, যশোরে ফিরে রাতের খাবার খেতে পারবেন।
এক বছর আগে ঝিকরগাছার কারও জন্য এটা ছিল স্বপ্নের মতো। শুধু ঝিকরগাছা নয়, পদ্মাপারের দক্ষিণের প্রায় সব জেলার মানুষের জন্য সেই স্বপ্নের বাস্তবায়ন যেন পদ্মা সেতু। সেই সেতু চালু হওয়ার এক বছর পূর্ণ হলো আজ ২৫ জুন।
রাজধানীর সঙ্গে দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের ২১ জেলাকে যুক্ত করেছে পদ্মা সেতু। এক বছর আগেও এসব জেলায় যেতে পার হতে হতো ফেরি। দুই ঈদে বাড়ি ফেরা বা ঈদের শেষে বাড়ি থেকে কর্মস্থলমুখী হওয়া, সে কী দুঃসহ যন্ত্রণা। বিপদ ছিল শীতেও, ঘন কুয়াশায় সারা রাত বন্ধ থাকত ফেরি। বর্ষায় নদীতে স্রোত বেশি, ভেঙে গেছে ঘাট, তো ফেরি বন্ধ। কত যন্ত্রণাই দিয়েছে পদ্মার ঘাট।
অথচ এক বছর হতে চলল, সেসব যেন পুরোনো দিনের স্মৃতি!
২০২২ সালের ২৫ জুন উদ্বোধন করা হয় ৬ দশমিক ১৫ কিলোমিটার দৈর্ঘ্যের পদ্মা সেতু। পরদিন ২৬ জুন সকাল থেকে শুরু হয় যান চলাচল। এর পর থেকে চলতি মাসের ৭ তারিখ পর্যন্ত ৭৫৮ কোটি ৮ লাখ ৭৫০ টাকার টোল আদায় করা হয়েছে এই সেতুতে। এর মধ্যে গত বছরের জুলাই মাসে সর্বোচ্চ ৭৮ কোটি ৫০ লাখ টাকার টোল আদায় হয়েছে। সেতু নির্মাণে খরচ হয়েছে ৩০ হাজার ১৯৩ কোটি টাকা। শোধ করা হয়েছে চার কিস্তির টাকা। আগামী ৩৫ বছরে অর্থাৎ ২০৫৭ সালে পর্যন্ত ১ শতাংশ সুদে ১৪০টি ত্রৈমাসিক কিস্তিতে শোধ করা হবে।
জেলায় জেলায় দ্বার খুলেছে অর্থনীতির
পদ্মা সেতু সবচেয়ে বেশি পরিবর্তন এনেছে খুলনা ও বরিশাল বিভাগের জেলাগুলোয়। রাজধানীর সঙ্গে খুলনার দূরত্ব ও সময় কমেছে। খুলনার কৃষি পণ্য ও মৎস্য দ্রুত ঢাকায় পৌঁছানো সম্ভব হয়েছে। মোংলা বন্দরের প্রতি দেশি-বিদেশি বিনিয়োগকারীদের আগ্রহও বেড়েছে।
খুলনা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপপরিচালক কাজী জাহাঙ্গীর হোসেন বলেন, সরকারিভাবে খুলনার চিংড়িসহ সাদা মাছ, তরমুজ, তিল, চুইঝাল, নারিকেলসহ প্রচলিত ও অপ্রচলিত কৃষিপণ্য এখন রপ্তানি হচ্ছে।
বেনাপোল বন্দর-সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা যায়, ভারতের বিভিন্ন রাজ্য থেকে আমদানি পণ্য নিয়ে ট্রাক ঢুকছে বেনাপোল বন্দরে। খালাস হয়ে মাত্র ৫ ঘণ্টায় পৌঁছে যাচ্ছে ঢাকায়।
বেনাপোল কাস্টম হাউসের যুগ্ম কমিশনার সাফায়েত হোসেন আজকের পত্রিকাকে বলেন, গত ১১ মাসে এই পথে ভারত থেকে আমদানি হয়েছে ১৮ লাখ ৮১ হাজার ৪১৯.০৩ মেট্রিক টন বিভিন্ন ধরনের পণ্য। ভারতে রপ্তানি হয়েছে ৯ হাজার ৫৭৭.১৯ কোটি টাকা মূল্যের ৪ লাখ ৫২ হাজার ৩১০.০৭ মেট্রিক টন পণ্য। রপ্তানি বেড়েছে আগের বছরের চেয়ে ৩২ হাজার মেট্রিক টন। আমদানি খাতে সরকারের রাজস্ব এসেছে ৫ হাজার ৩৬০ কোটি ৭৮ কোটি টাকা, যা আগের বছরের একই সময়ের চেয়ে ১ হাজার ২২৫ কোটি ২০ লাখ টাকা বেশি।
বরিশালের ছোট ছোট ব্যবসায়ীরা এখন স্বপ্ন দেখছেন ঢাকাকেন্দ্রিক ব্যবসার। বরিশাল মৎস্য কর্মকর্তা (ইলিশ) ড. বিমল চন্দ্র দাস বলেন, দক্ষিণাঞ্চলের ইলিশ এখন সড়কপথে রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন শহরে যাচ্ছে।
বাংলাদেশ অর্থনীতি সমিতির কেন্দ্রীয় সদস্য অধ্যাপক মো. আখতারুজ্জামান খান বলেন, উৎপাদিত পণ্য এবং কাঁচামাল আনা-নেওয়া সহজ হয়েছে। মুগ ডাল, তরমুজ, পেয়ারা, মাছ ঢাকা যাচ্ছে কম সময়ের মধ্যে।
সুন্দরবন পূর্ব বন বিভাগের বিভাগীয় বন কর্মকর্তা মোহাম্মাদ বেলায়েত হোসেন বলেন, গত এক বছরে সুন্দরবনে ১ লাখ ৩৭ হাজার ৩৮ জন দেশি ও ১ হাজার ৬৭৫ জন বিদেশি দর্শনার্থীর আগমন ঘটেছে। যার মাধ্যমে সরকারের রাজস্ব আদায় হয়েছে ১ কোটি ৮৭ লাখ ৬৭ হাজারে টাকা, যা গত বছরের তুলনায় দ্বিগুণ।
প্রত্নতত্ত্ব বিভাগের কাস্টডিয়ান মোহাম্মাদ যায়েদ বলেন, পদ্মা সেতু চালুর পর ষাটগম্বুজ দেখতে ৪ লাখ ৯৬ হাজার ৮ জন দেশি ও ১ হাজার ৪৮২ জন বিদেশি দর্শনার্থী এসেছেন। যার মাধ্যমে রাজস্ব আদায় হয়েছে ৮৭ লাখ টাকা।
এদিকে পণ্য আমদানি ও রপ্তানির ক্ষেত্রে ব্যবসায়ীরা মোংলা বন্দরের দিকে ঝুঁকছেন। এই বন্দরে কনটেইনারবাহী জাহাজের আগমন বেড়েছে ১৫ শতাংশ। ২০২১-২২ অর্থবছরে জাহাজ এসেছিল ৪৫টি, এবার এসেছে ৫২টি।
সেতু হয়েও যেসব সমস্যার সমাধান হয়নি
পদ্মা সেতু চালুর এক বছরে দক্ষিণাঞ্চলের অর্থনীতিতে যেমন ইতিবাচক পরিবর্তন এসেছে, তেমন টেকসই উন্নয়নের পরিকল্পনা না থাকায় সবচেয়ে বড় খাত শিল্পের উন্নয়নে এ অঞ্চলে ধীরগতিই রয়ে গেছে।
বিশেষজ্ঞদের মতে, দক্ষিণে বিনিয়োগকারীদের চোখ পড়লেও শিল্পপ্রতিষ্ঠান গড়ে তুলতে ভরসা পাচ্ছেন না। এর অন্যতম কারণ গ্যাস সরবরাহ না থাকা, ফোর লেন ও রেললাইনে অনগ্রসর, অর্থনৈতিক অঞ্চল না থাকা এবং পায়রা বন্দর সচল না হওয়া।
অর্থনীতিবিদ মো. আখতারুজ্জামান খান মনে করেন, কৃষির অগ্রগতি হলেও শিল্প খাতে এ অঞ্চলে ধীরগতি। পায়রা বন্দরের কার্যকারিতা না থাকায় পদ্মা সেতুর সুবিধা বিনিয়োগকারীরা পাচ্ছেন সুবিধা।