ভবনের অনুমোদন ও ব্যবহার কাজে মিল নেই : দুর্ঘটনা ঘটলেই চলে দায় এড়ানোর চেষ্টা নেই কোন সমাধান।
নিউজ ডেস্ক আদালত বার্তাঃ ২ মার্চ, ২০২৪
ভবনের অনুমোদন ও ব্যবহার কাজে মিল নেই : দুর্ঘটনা ঘটলেই চলে দায় এড়ানোর চেষ্টা নেই কোন সমাধান।
রাজধানীর বেইলি রোডের ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডের পর ফের ভবন ব্যবস্থাপনা নিয়ে কথা উঠেছে। বিশেষ করে যে সব দায়িত্বশীল সংস্থা এসব ভবনের নকশা, পরিবেশ ও নিরাপত্তাগত ছাড়পত্র প্রদান ও তদারকি করে সে সব সংস্থার দায়িত্বশীলতা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, প্রায় ২ কোটি মানুষের এই শহরে যত্রতত্র গড়ে উঠছে হোটেল-রেস্তোরাঁ ও বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান। এতে একদিকে যেমন নগরীর ট্রাফিক ব্যবস্থাপণায় বিঘ্ন ঘটছে অপরদিকে বাড়ছে নিরাপত্তা ঝুঁকি। যার সর্বশেষ দৃষ্টান্ত বেইলি রোডের সাত তলা ওই ভবনটি।
এদিকে, অগ্নিকাণ্ডের ঘটনাকে কেন্দ্র করে রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ ও ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশন একে অন্যের ঘাড়ে দায় চাপানোর চেষ্টা করছে। নির্মাণগত ত্রুটি নয় বরং ব্যবহারগত ত্রুটির কারণেই অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটেছে রাজধানী উন্নয়ন কর্তপক্ষ-রাজউক এমন দাবি করলেও তা নাকচ করেছে ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশন।
পুলিশ কর্মকর্তারা বলছেন, বেইলি রোডের ওই ভবনটি নির্মানের সময় আবাসিক ভবন হিসেবেই অনুমোদন দেয় রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ। তবে পরে বেশি ভাড়া পাওয়ায় লোভে ভবন কর্তৃপক্ষ রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ রাজউকের পরিদর্শকদের ম্যানেজ করে সেখানে রেস্টুরেন্ট খুলে বসে। অগ্নিকাণ্ডে হতাহতের ঘটনায় শনিবার রমনা মডেল থানায় পুলিশের পক্ষ থেকে দায়ের করা মামলায় এ বিষয়টিই তুলে ধরা হয়েছে। পুলিশ বলছে, ভবনটির আবাসিক অনুমোদন থাকলেও রাজউক কর্মকর্তাদের ম্যানেজ করে অবৈধভাবে তাতে বাণিজ্যিক কার্যক্রম চালানো হচ্ছিলো।
এ বিষয়ে রাজউকের সাবেক প্রধান প্রকৌশলী এমদাদুল ইসলাম বলেন, বেইলি রোডের যে ভবনটিতে আগুন লেগে বহু হতাহতের ঘটনা ঘটে সেটি প্রথমে আবাসিক হিসেবে অনুমোদন নিলেও পরবর্তীকালে বাণিজ্যিক হিসেবে ব্যবহার শুরু করে। আর বাণিজ্যিক হিসেবে ব্যবহার শুরু হলেও নকশায় পরিবর্তন এনে সে অনুযায়ী প্রয়োজনীয় নিরাপত্তা ব্যবস্থা গড়ে তোলা হয়নি। বাণিজ্যিক ভবনের অনুমোদন নিতে পরিবেশ অধিদপ্তর, ফায়ার সার্ভিস অধিদপ্তর ও ট্রাফিক ব্যবস্থাপনার ছাড়পত্র লাগে, কিন্তু সেগুলো নেওয়া হয়নি।
তিনি আরও বলেন, ভবনটি আবাসিক হিসেবে নির্মাণ করে বাণিজ্যিক হিসেবে ব্যবহার শুরু করা হয়েছে। একটি আবাসিক ভবনের স্ট্রাকচারাল ডিজাইন (অবকাঠামোগত নকশা) আর একটি বাণিজ্যিক ভবনের স্ট্রাকচারাল ডিজাইন একরকম নয়। আটতলা একটি আবাসিক ভবনে একটি সিঁড়ি হলেই চলত। কিন্তু বাণিজ্যিক ভবনে দুটি সিঁড়ি রাখতে হবে, যার একটি ফায়ার এক্সিট হিসেবে ব্যবহার করা যাবে। কারণ আবাসিক ভবনে হলে মানুষের সমাগম হবে কম। আর বাণিজ্যিক হলে মানুষের সমাগম হবে বেশি। তাছাড়া বাণিজ্যিক ভবনে রান্নার জন্য গ্যাসসহ বিভিন্ন ইলেকট্রনিকস সরঞ্জামের ব্যবহার বেশি হবে। যে কারণে বাণিজ্যিক ভবনগুলো আবাসিক ভবন থেকে বেশি ঝুঁকিতে থাকে। আর যদি পুরো ভবন জুড়ে রেস্টুরেন্ট থাকে তাহলে ঝুঁকি স্বাভাবিকভাবেই আরও বেড়ে যায়।
জানা গেছে, ‘গ্রিন কোজি কটেজ’ ভবনটি আমিন মোহাম্মাদ গ্রুপের মালিকানাধীন। ভবনটি আবাসিক কাম অফিস (এ-২ এবং এফ-১) হিসেবে ব্যবহারের অনুমোদন দেয় রাজউক। কিন্তু সেটি আবাসিক কাম রেস্টুরেন্ট (এ-২ এবং এফ-২) হিসেবে ব্যবহার করা হয়েছে। ইউজেবল ডেভিয়েশনের (ব্যবহার বিচ্যুতি) কারণে সেখানে আগুন লাগার পর তা মারাত্মক আকার ধারণ করে বলে জানিয়েছেন রাজউক কর্মকর্তারা।
তারা বলেছেন, ভবনটিতে দোকান-রেস্টুরেন্ট ব্যবসা পরিচালনার লাইসেন্স দিয়েছে সিটি করপোরেশন। যারা লাইসেন্স দিয়েছে তাদের আগে দেখার দরকার ছিল ভবনটির ফায়ার ফাইটিং সিস্টেম (অগ্নিনির্বাপণ ব্যবস্থা) ঠিক আছে কি না।
রাজউকের এক কর্মকর্তা জানান, ভবনটিতে দোকান-রেস্টুরেন্ট পরিচালনার জন্য সিটি করপোরেশন যখন ট্রেড লাইসেন্স দিয়েছে তখন দেখা দরকার ছিল ভবনটির নকশার অনুমোদনে কী আছে এবং ফায়ার এক্সিট ও অগ্নিনির্বাপণ সরঞ্জামাদি পর্যাপ্ত আছে কি না। এ বিষয়গুলো সিটি করপোরেশন ও ফায়ার সার্ভিসের দেখার কথা। রাজউক স্ট্রাকচারাল কোনো ডেভিয়েশন (নকশার বিচ্যুতি) আছে কি না, সেটি দেখে থাকে। ভবনটির স্ট্রাকচারাল কোনো ডেভিয়েশন পাওয়া যায়নি। কিন্তু ভবনটি আবাসিক কাম অফিসের বদলে আবাসিক কাম রেস্টুরেন্ট হিসেবে ব্যবহার করা হয়েছে। অর্থাৎ ভবনের ইউজেবল ডেভিয়েশন আছে। এ কারণে অগ্নিকাণ্ড মারাত্মক আকার ধারণ করেছে।
জানা গেছে, বেইলি রোড এলাকাটি রাজউকের জোন-৬-এর আওতাভুক্ত। ওই জোনের পরিচালক সালেহ আহমেদ জাকারিয়া জানান, গ্রিন কোজি কটেজ ভবনটি আবাসিক কাম অফিস স্পেস হিসেবে একটি বেজমেন্টসহ আটতলা নির্মাণে নকশার অনুমোদন দেওয়া হয়েছিল। ভবনটি অনুমোদিত নকশা অনুযায়ী নির্মাণ করা হয়েছে।
বিষয়টি ক্ষতিয়ে দেখতে একটি একটি তদন্ত কমিটি করা হয়েছে। আগামী সাত কার্যদিবসের মধ্যে ওই কমিটি তাদের প্রতিবেদন প্রকাশ করবে। তখন আসলে অগ্নিকাণ্ড ও হতাহতের প্রকৃত কারণ জানা যাবে বলে মন্তব্য করেন তিনি।
এদিকে রাজউকের পক্ষ থেকে ভবনের নির্মাণগত কোনো ত্রুটি নেই-এমন দাবি করা হলেও ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশন কর্তৃপক্ষ সেটি মানতে নারাজ। অগ্নিকাণ্ডের জন্য রাজউক এর ইউজেবল ডেভিয়েশন বা ব্যবহারগত ত্রুটিকে দায়ি করলেও ঢাকা দক্ষিণ সিটির মেয়র ফজলে নূর তাপস তা অস্বীকার করেছেন। অগ্নিকাণ্ডের পেছনে তিনি ভবনের নকশা বা স্ট্রাকচারাল ডেভিয়েশনকেই দায়ি করেছেন।
তিনি বলেছেন, ‘আমাদের প্রাথমিক পরিদর্শন এবং তথ্য থেকে আমরা যতটুকু জানতে ও দেখতে পেয়েছি, এই ভবন নির্মাণে অনেক গাফিলতি করা হয়েছে। এ ভবন নির্মাণে ইমারত নির্মাণ বিধিমালা, বিএনবিসি কোডে যে নির্ণায়কগুলো রয়েছে সেগুলো সম্পূর্ণরূপে লঙ্ঘন করা হয়েছে। আমরা পরিদর্শনে দেখলাম, দশতলা ভবন হওয়া সত্ত্বেও মাত্র একটি সিঁড়ি রয়েছে এবং সেই সিঁড়িটাও নির্ধারিত মানদণ্ড অনুযায়ী প্রশস্ত নয়। ইমারত নির্মাণ বিধিমালা অনুযায়ী পাঁচতলার ওপরে ভবন হলেই একটি ভবনে দুটো সিঁড়ি থাকতেই হবে এবং একটি সিঁড়ি জরুরি সাড়া প্রদানের জন্য নির্ধারিত থাকবে। অগ্নিকাণ্ড, ভূমিধসসহ যেকোনো ধরনের প্রাকৃতিক দুর্যোগকালে সেটি ব্যবহৃত হবে। কিন্তু এ ভবনে তা মানা হয়নি বলেই অগ্নিকাণ্ডে এত হতাহত হয়েছে।’
ফজলে নূর তাপস আরও বলেন, ‘এ ধরনের ব্যাপক প্রাণহানি ও ক্ষয়ক্ষতি এড়াতে ইমারত নির্মাণ বিধিমালা পূর্ণাঙ্গরূপে বাস্তবায়ন ও পরিপালন করা জরুরি।
এদিকে নগর পরিকল্পনাবিদরা বলছেন, ভবনের অনুমোদনের পর সেই ভবনে কোন ধরণের কর্মকান্ড চলবে সেটি দেখভালের জন্যও যথযথ কর্তৃপক্ষ রয়েছে। এ ধরণের কোনো দুর্ঘটনা ঘটার পর কেবল পরস্পর বিরোধী কথাবার্তা চলে। অথচ ওই কর্তৃপক্ষগুলো তাদের দায়িত্ব সঠিক ভাবে পালন করলেই এসব দুর্ঘটনা এড়ানো সম্ভব।
এ বিষয়ে বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব প্লানার্স-বিআইপির সাধারণ সম্পাদক ও নগর পরিকল্পনাবিদ ড. আদিল মোহাম্মদ খান বলেন, একটি ভবন আবাসিকের অনুমোদন নিয়ে সেখানে বছরের পর বছর বাণিজিক কার্যক্রম পরিচালনা করলো অথচ কোনো কর্তৃপক্ষেরই সেটি নজরে আসলো এটি অস্বাভাবিক। নিদিৃষ্ট কর্তৃপক্ষ অবশ্যই বিষয়টি জানতো কিন্তু সেখান থেকে তারা আর্থিক সুবিধা নেওয়ায় এই অনিয়মে কোনা বাধা দেয়নি। ঢাকা শহরে এমন হাজারো ভবন রয়েছে যেগুলোতে এমন অনিয়ম হচ্ছে। রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক ক্ষমতা ব্যবহার করে ব্যবসায়িরা অবৈধ কাজ চালিয়ে যাচ্ছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, রাজউক, সিটি কর্পোরেশনসহ সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলোর কর্মকর্তারা ব্যবসায়িদের এমন অনৈতিক কাজের আর্থিক সুবিধা নিয়ে থাকে।
তিনি বলেন, কোনো একটি দুর্ঘটনা ঘটার পর একে অন্যের ওপর দায় চাপানোর প্রবণতা আমাদের জাতীয় সমস্যা। অথচ সংস্থাগুলোর নিজস্ব রুলস অব বিজনেস রয়েছে। সেটি মেনে চললেই এ ধরণের অনিয়ম বন্ধ হয়। কিন্তু দু:খজনক হলেও সত্য অনিয়ম, দুর্নীতি আর রাজনৈতিক কারণে অনিয়মগুলো দিন দিন বেড়েই চলেছে।