সন্তান দত্তক সংক্রান্ত আইন।
ডেস্ক নিউজ আদালত বার্তা :২৪ মার্চ ২০২৩।
বাংলাদেশে শিশু দত্তক নেওয়া সংক্রান্ত কোনো বিধান বা আইনি কাঠামো নেই। তবে দত্তক বা সন্তান পালক নেওয়ার বিষয়টি থেমে নেই। সমাজবিজ্ঞানীদের মতে, নানা কারণেই নিঃসন্তান দম্পতির সংখ্যা বাড়ছে এবং অনেকেই এখন শিশু দত্তক নিতে চাইছেন। যদি পরিত্যক্ত শিশুর ‘অভিভাবকত্ব’ নিতে চান, তারা পারিবারিক আদালতের মাধ্যমে আবেদন করতে পারেন। দত্তক নেওয়ার ইচ্ছা থাকলেও অনেকেই আইনি জটিলতার কারণে দত্তক নিতে পারছেন না; দত্তক আইন না থাকাকে সমস্যা মনে করছেন। অনেকেই চাইছেন, এমন আইন করা হোক, যাতে শিশুটি পরিবারের সদস্য হিসেবে বিবেচিত হয় এবং সম্পত্তির উত্তরাধিকারী হিসেবে স্বীকৃতি পায়। দত্তক শিশুর জন্য সুনির্দিষ্ট নীতিমালা এবং সার্বক্ষণিক পর্যবেক্ষণের ব্যবস্থা করতে হবে। বাংলাদেশে আইন কমিশন থেকে পৃথক একটি দত্তক আইন প্রণয়নের জন্য সুপারিশ করা হয়েছে। গত বছর দত্তক আইন প্রণয়নের জন্য আইন মন্ত্রণালয়ের কাছে একটি সুপারিশপত্র পাঠালেও এ ব্যাপারে এখনো কোনো আলোচনা শুরু হয়নি।
বাংলাদেশের আইনে শিশু দত্তক নেওয়ার সরাসরি কোনো বিধান নেই। তবে দত্তকের বিধান রয়েছে অভিভাবকত্ব আইনে। ১৯৮৫ সালের পারিবারিক আইনের মাধ্যমে কোনো শিশুর দায়ভার নিতে পারেন একজন অভিভাবক হিসেবে; পিতা বা মাতা হিসেবে নয়। অভিভাবকত্ব আর দত্তক এক বিষয় নয়। অভিভাবকত্ব আইনের মাধ্যমে জটিলতার কারণে মানুষ দত্তক নিতে উৎসাহিত হয় না। তবে উচ্চ আদালতের একটি নির্দেশের পর শুধু হিন্দু আইনে হিন্দু পুত্রসন্তানের ক্ষেত্রে বিষয়টি আইনসিদ্ধ। এদিকে, বাংলাদেশে হিন্দু আইনে দত্তক নেওয়ার বিধান থাকলেও শুধু ছেলে শিশু দত্তক নেওয়া যাবে। হিন্দু পুরুষ বিবাহিত, অবিবাহিত বা বিপতœীক যা-ই হোক না কেন, তার দত্তক নেওয়ার স্বাধীনতা রয়েছে। এ ক্ষেত্রে নারীদের অধিকার সীমিত। একজন অবিবাহিত নারী দত্তক নিতে পারেন না। বিবাহিত নারীর ক্ষেত্রে স্বামীর অনুমতি দরকার। এমনকি বিধবা হিন্দু নারী দত্তক নিতে চাইলে তাকে স্বামীর মৃত্যুর আগে দেওয়া অনুমতি দেখাতে হবে। খ্রিস্টধর্মেও প্রাতিষ্ঠানিকভাবে দত্তক নেওয়ার বিধান নেই। বাংলাদেশের খ্রিস্টানরাও শিশুর শুধু অভিভাবকত্ব নিতে পারেন।
একটি গৃহহীন অথবা অনাথ শিশুর অভিভাবক হয়ে আশ্রয় বা লালন-পালন করলে সেটা শুধু বৈধই নয়, ইবাদতও বটে। এ ক্ষেত্রে অসহায় শিশুর প্রতি মমতাই মুখ্য উদ্দেশ্য। ওই শিশুর মঙ্গলে সরল বিশ^াসে কৃতকাজ অবশ্যই প্রশংসার দাবিদার। পালিত, আশ্রিত, পোষ্য, দত্তকÑ যে নামেই ডাকা হোক, উদ্দেশ্যটা হয় পরোপকার। এই শিশুর দায়িত্ব ছিল রাষ্ট্রের বা সমাজের; সেটাই আপনি করলেন। প্রাকৃতিক দুর্যোগে বা দুর্ভাগ্যজনক কোনো ঘটনার কারণে পরিবারে ভাঙন সৃষ্টি হয় এবং জীবন তছনছ হয়ে যায়। অনাথ শিশুকে সাহায্য করা এবং একটি সুন্দর জীবনযাপনের সুযোগ করে দেওয়া সবার দায়িত্ব। দত্তক নেওয়া মহৎ কাজ। এই অনাথ শিশুটিই হয়তো একদিন জগদ্বিখ্যাত হতে পারে। বর্ণবাদবিরোধী আন্দোলনের নেতা নেলসন ম্যান্ডেলা, অ্যাপলের সহ-প্রতিষ্ঠাতা এবং সিইও স্টিভ জবসও ছিলেন দত্তক সন্তান।
অপরদিকে, নিজের একাকিত্ব ঘোচানোর জন্য অর্থ দিয়ে, রাস্তা থেকে অথবা শিশুসদন থেকে এনে শিশুকে পালন করাও দত্তক। এখানে শিশুর প্রতি দরদ দেখানোর কারণ উত্তরসূরি তৈরি। অবলম্বন হয়ে ওঠা শিশুটি হয়তো কোনো দিন তার আসল বাবা-মায়ের পরিচয় জানতে পারে না। আবার অনেক ক্ষেত্রে সত্যিকারের পিতা-মাতারা দেখা করতে এলেও তাদের সেই সুযোগ দেওয়া হয় না। এমনসব সম্ভাব্য বঞ্চনা এড়াতে তথা শিশুর অধিকার রক্ষার নিমিত্তেই ইসলামের বিধি-বিধান পালিত হচ্ছে মুসলিম রাষ্ট্রের মাধ্যমে।
আল্লাহ পবিত্র কোরআনে বিধান দিয়েছেন দত্তক বা পালিত পুত্রদের প্রতি দায়িত্ব সম্পর্কে। মুসলিম বিধানমতে, কারো অধীনস্থ পোষ্য ছেলে বা মেয়ের নাম অবশ্যই পালিত পিতার বংশীয় পদবি থেকে ভিন্ন হওয়া উচিত, যেন ভবিষ্যতে সম্পত্তির উত্তরাধিকার প্রশ্নে ভুল বোঝাবুঝির সম্ভাবনা না থাকে। তাছাড়া ভবিষ্যতে রক্তের সম্পর্কের কোনো মহরম আত্মীয়কে বিয়ে করার সম্ভাবনা এড়ানো যায়।
সন্তানহীন দম্পতির দত্তক নেওয়ার যে উদ্দেশ্য, তাতে নিজেদের অবলম্বন খোঁজাই মুখ্য। অবশ্য এতে সমস্যা নেই, ভালো থাকার অধিকার সবারই আছে। তবে এমন পরিবারে দত্তক সন্তানের পাশাপাশি নিজের ঔরসজাত সন্তানের জন্ম অনেক ক্ষেত্রে জটিলতা ডেকে আনে। দত্তক সন্তানকে নিজ সন্তানের উপস্থিতিতে সমপরিমাণ যতœ নেওয়া বাস্তবে অসম্ভব। এতেও সমস্যা নেই, যদি অন্তত মানবিক আচরণ বজায় থাকে। অনেক ক্ষেত্রে দেখা গেছে, সন্তানহীন দম্পত্তির পূর্বেকার দরদ-ভালোবাসা উধাও হয়ে যায় আপন সন্তানের আগমনে।
যেখানে আপন দুই সন্তানের মধ্যে ন্যায়বিচার করা হয় না বা অনিচ্ছাকৃত বৈষম্য হয়ে যায়, সেখানে দত্তক সন্তানের প্রতি সমভাবে ন্যায়বিচার দুর্বলচিত্ত মানবের জন্য মহাপরীক্ষা। এই কঠিন দায়িত্ব থেকে অব্যাহতি দিয়ে আল্লাহ মানুষের জীবন সহজ করে দিয়েছেন। ‘দত্তক’ নেওয়ার কাজটা হারাম করা হয়নি। কোরানে দত্তক সন্তানের প্রতি কর্তব্য পালনে সীমারেখা রয়েছে, যাতে আল্লাহর প্রদত্ত বিধানমতো মানুষ আচরণ করতে পারে। দত্তক নিতে ইসলাম বাধা দেয় না, বরং উৎসাহিত করে। ইসলাম যে ব্যাপারে বাধা দেয়, তা হচ্ছে, কারো প্রতি জুলুম। অনেক ক্ষেত্রে নিজের গরিব আত্মীয় অভাবের তাড়নায় অন্যের কাছে হাত পাতে। তাদেরকে সাহায্য না করে দত্তকের জন্য অর্থ ব্যয় হচ্ছে। আসলে দান-সদকা হতে হয় নিঃশর্ত এবং আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য। তা না হয়ে যখন তা নিজের একাকিত্বের সঙ্গী করার পেছনে ব্যয় হয়, তা প্রকৃত অর্থে বিনিয়োগ হয়ে যায়।
বাংলাদেশে দত্তক বিষয়টির একটি আন্তর্জাতিক প্রেক্ষাপট আছে। ১৯৫৯ সালের ঘোষণার ৩০ বছর পর ১৯৮৯ সালে শিশু অধিকার কনভেনশন গৃহীত হয়। বাংলাদেশ এই কনভেনশনে স্বাক্ষর দিলেও দত্তক গ্রহণ বিষয়ক অনুচ্ছেদ ২১ সম্পর্কে আপত্তি উত্থাপন করে। আপত্তির কারণ হলো, মুসলিম আইনে দত্তক গ্রহণ স্বীকৃত নয়। স্বাধীনতার পর যুদ্ধশিশু উদ্ধারের ক্ষেত্রে ব্যাপক ভূমিকা থাকলেও বাংলাদেশ আন্তর্দেশীয় দত্তক গ্রহণে অনাগ্রহী। অনেক ক্ষেত্রেই দত্তক গ্রহণের নামে শিশু বিক্রির ঘটনাও ঘটে। ধর্মীয়, নৈতিক ও সামাজিক কারণেই এ দেশের জনমত আন্তর্দেশীয় দত্তক গ্রহণের বিরুদ্ধে।
বাংলাদেশে শিশুদের অধিকার সংরক্ষণ এবং তাদের কল্যাণ নিশ্চিতকরণের জন্য সাংবিধানিক বিধান ও অনেক আইন রয়েছে। বাংলাদেশের সংবিধানের ২৭, ২৮ ও ৩১ অনুচ্ছেদে সব ধরনের বৈষম্য থেকে শিশুর নিরাপত্তা বিধানের সাধারণ নীতিমালার উল্লেখ রয়েছে। বলা আছে, আইনের দৃষ্টিতে সব নাগরিক সমান এবং অভিন্ন নিরাপত্তা লাভের অধিকারী বিধায় পক্ষপাতহীনভাবে তাদের আইনের সুযোগ লাভের অধিকার রয়েছে। এছাড়া শিশুদের নিরাপত্তা ও কল্যাণ সম্পর্কিত বিধান বাংলাদেশের ৪০টির বেশি আইন ও সংবিধিতে ছড়িয়ে আছে। এতসব বিধান আইনে থাকার পরও বাংলাদেশের সাংস্কৃতিক এবং ধর্মীয় ঐতিহ্যের বিস্তৃত পরিম-লে এমন পরিস্থিতির উদ্ভব ঘটে যে, তাতে প্রায়ই বৈষম্য এড়ানো যায় না। বিদ্যমান আইনে কেউ কেউ কিছু বিশেষ সীমাবদ্ধতা দেখছেন। যেমনÑ পোষ্য পশুপাখির মতো পালক শিশুদের নিজের বলে দাবি করা যায় না। ঝুঁকি থাকে প্রতিদানহীন খরচের। ১৯৭১ সালে স্বাধীনতাযুদ্ধে ধর্ষণের শিকার নারীদের গর্ভে জন্ম হওয়া শিশুদের পুনর্বাসনের লক্ষ্যে তাদের দত্তক দিতে ১৯৭২ সালে একটি বিশেষ আইন প্রণীত হয়েছিল। পরবর্তীকালে শিশু পাচার বা ধর্মান্তরিত হওয়ার ঘটনার প্রেক্ষাপটে ১৯৮২ সালে সরকার আইনটি বাতিল করে। সেটা বাতিল হওয়ার আগ পর্যন্ত বহু পরিত্যক্ত শিশুকে ওই আইনের আওতায় দত্তক দেওয়া হয়েছিল।
বাংলাদেশের বহু-পুরনো সংস্কারযোগ্য আইনগুলোকে হালনাগাদ করার সরকারি সিদ্ধান্ত সাধুবাদ পাওয়ার দাবি রাখে। নানা মহল থেকেই অনেক প্রস্তাব উঠে এসেছে, যা সময়ের দাবি। নাম যা-ই হোক, নিগৃহীত ও অবহেলিত শিশুদের সুরক্ষার বিধান রেখে আইন থাকা যুক্তিসঙ্গত। তবে কাগজে-কলমে সীমাবদ্ধ থাকলে কোনো লাভ হবে না। সংস্কার, সংযোজন বা বিয়োজন যেন কোনো ধর্মীয় অনুভূতি কিংবা ধর্মীয় বিধানবিরোধী না হয়। এ ক্ষেত্রে ইসলামী আইনের আওতায় থেকেই ইজতিহাদের (গবেষণা) মাধ্যমে সমাধান বের করার চেষ্টা করতে হবে এবং সেই অনুসারে আইন প্রণয়ন করা যেতে পারে।