সাজা নির্ধারণে আলাদা শুনানি করতে হবে: হাইকোর্ট।
ডেস্ক নিউজ, আদালত বার্তা :২১ মে ২০২৩।
ফৌজদারি মামলায় রায় ঘোষণার আগে অভিযুক্ত ব্যক্তিকে সাজা দেওয়ার বিষয়ে বিচারিক আদালত ও ট্রাইব্যুনালকে পৃথক শুনানি করতে হবে—হাইকোর্টের এক রায়ে এমন নির্দেশনা এসেছে। হাইকোর্ট বলেছেন, এ জন্য পক্ষগুলোর চূড়ান্ত যুক্তি–তর্ক উপস্থাপন শেষে রায় ঘোষণার আগে একটি তারিখ নির্ধারণ করতে হবে।
এই রায়ের মধ্য দিয়ে দেশের বিচারব্যবস্থায় নতুন দিগন্তের সূচনা হবে—এমনটাই মনে করছেন একাধিক আইনজীবী। তাঁরা বলছেন, যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, অস্ট্রেলিয়াসহ বিভিন্ন দেশে অভিযুক্ত ব্যক্তি দোষী না নির্দোষ, তা প্রথমে একটি আদালত নির্ধারণ করেন।দোষী হলে সাজার মেয়াদ কী হবে, তা অন্য আদালতে নির্ধারিত হয়। কিন্তু বাংলাদেশে অভিযুক্ত ব্যক্তিকে দোষী সাব্যস্ত করা ও সাজা একই আদালত দিয়ে থাকেন। সাজার সুনির্দিষ্ট নীতিমালা না থাকায় একই অপরাধে সাজা দেওয়ার ক্ষেত্রে তারতম্যও দেখা যায়।
একাধিক আইনজীবী বলছেন, সাজা প্রদানবিষয়ক শুনানিতে অপরাধ সংঘটন পরিস্থিতি; অপরাধীর বয়স ও চরিত্র; অপরাধী অভ্যাসগত, সাধারণ বা পেশাদার কি না—এসব দিক বিবেচনায় রাখতে বলা হয়েছে। তাই এই শুনানির সময় পক্ষগুলো বিষয়গুলো বিস্তারিত তুলে ধরার সুযোগ পাবে। সংশ্লিষ্ট আদালত সাজা নির্ধারণের ক্ষেত্রে আরও পর্যালোচনা এবং বিচার–বিশ্লেষণ করতে পারবেন। একই অপরাধে সাজা প্রদানের ক্ষেত্রে তারতম্যও অনেকাংশেই নিরসন হবে।
‘রাষ্ট্র বনাম মো. লাভলু’ শিরোনামে এক মামলায় (এক ডেথ রেফারেন্স) বিচারপতি শেখ হাসান আরিফ ও বিচারপতি বিশ্বজিৎ দেবনাথের সমন্বয়ে গঠিত হাইকোর্ট বেঞ্চ গত ২৭ ও ২৮ ফেব্রুয়ারি ওই রায় দেন। ৮৪ পৃষ্ঠার পূর্ণাঙ্গ রায়টি গত বৃহস্পতিবার সুপ্রিম কোর্টের ওয়েবসাইটে প্রকাশ করা হয়।
পৃথক শুনানি করতে তারিখ নির্ধারণ করতে হবে
রায়ে আদালত বলেছেন, দেশের বিচারিক আদালত ও ট্রাইব্যুনালকে রায় ঘোষণার আগে অভিযুক্ত ব্যক্তির সাজা প্রদান বিষয়ে পৃথক শুনানির জন্য নির্দেশ দেওয়া যাচ্ছে।
পদ্ধতি সম্পর্কে রায়ের নির্দেশনায় বলা হয়, পক্ষগুলো চূড়ান্ত যুক্তিতর্ক শেষে যখন বিচারক অভিযুক্ত ব্যক্তিকে অপরাধের জন্য মৃত্যুদণ্ড বা যাবজ্জীবন কারাদণ্ড বা কয়েক বছরের কারাদণ্ডের মাধ্যমে দোষী সাব্যস্ত করতে মনস্থির করেন, তখন বিচারক তাঁর এই মনোভাবের কথা উন্মুক্ত আদালত বা ট্রাইব্যুনালে পক্ষগুলোর কাছে প্রকাশ করবেন। এরপর বিচারক অভিযুক্ত ব্যক্তির যথাযথ সাজা নির্ধারণের জন্য শাস্তির বিষয়ে পৃথক শুনানির জন্য সম্ভাব্য স্বল্পতম সময়ের মধ্যে একটি তারিখ নির্ধারণ করবেন। এ ধরনের শুনানিতে পক্ষগুলো অভিযুক্ত ব্যক্তির সামাজিক পটভূমি, অপরাধের রেকর্ড, বয়স ও আর্থিক অবস্থা ইত্যাদি তুলে ধরতে পারবেন। এ ধরনের শুনানিতে বিচারিক সাজার প্রকৃতি, অপরাধ সংঘটন পরিস্থিতি, অপরাধীর বয়স ও চরিত্র, ব্যক্তি বা সমাজের প্রতি ক্ষতি; অপরাধী অভ্যাসগত, সাধারণ বা পেশাদার কি না, অপরাধীর ওপর শাস্তির প্রভাব, বিচারে বিলম্ব এবং দীর্ঘদিন চলা বিচারের সময় অপরাধীর ভোগা মানসিক যন্ত্রণা, এমনকি অপরাধীর সংশোধন ও সংস্কারের দিক নজরে রাখতে হবে। এসবের পর বিচারক সাজাসহ দোষী সাব্যস্তকরণ বিষয়ে রায় এবং আদেশ দেবেন।
সাজা দেওয়ার ক্ষেত্রে রায়ের নির্দেশনা বাস্তবায়নের জন্য সংশ্লিষ্ট আদালত এবং ট্রাইব্যুনালে নির্দেশনাসংবলিত রায়ের অনুলিপি পাঠাতে বা এ বিষয়ে সার্কুলার জারি করতে সুপ্রিম কোর্টের রেজিস্ট্রার জেনারেলের প্রতি নির্দেশ দিয়েছেন হাইকোর্ট। এ বিষয়ে প্রয়োজনীয় কার্যক্রমের জন্য রায়ের অনুলিপি আইন, বিচার ও সংসদবিষয়ক সচিব বরাবর পাঠাতেও বলা হয়েছে।
মামলার নথিপত্র থেকে জানা যায়, যশোরে এক শিশুকে ধর্ষণ ও হত্যার ঘটনায় নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনে মামলা করা হয়। এই মামলায় নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনাল ২০১৭ সালের ৩০ মে মো. লাভলুকে মৃত্যুদণ্ড দেন। মৃত্যুদণ্ড অনুমোদনের (ডেথ রেফারেন্স) জন্য বিচারিক আদালতের রায়সহ নথিপত্র হাইকোর্টে আসে, যা ওই বছরই ডেথ রেফারেন্স মামলা হিসেবে নথিভুক্ত হয়। বিচারিক আদালতের রায়ের বিরুদ্ধে জেল আপিল ও আপিল করেন লাভলু। একসঙ্গে শুনানি শেষে গত ২৭ ও ২৮ ফেব্রুয়ারি হাইকোর্ট রায় দেন। রায়ে লাভলুকে মৃত্যুদণ্ডের পরিবর্তে সাজা কমিয়ে যাবজ্জীবন কারাদণ্ডাদেশ দেওয়া হয়। আদালতে আসামিপক্ষে শুনানিতে ছিলেন আইনজীবী এম এ মুনতাকিম ও চৌধুরী শামসুল আরেফিন। রাষ্ট্রপক্ষে শুনানিতে ছিলেন ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল হারুনুর রশীদ ও সহকারী অ্যাটর্নি জেনারেল জাহিদ আহমেদ।
হাইকোর্টের এই রায়ের ফলে বিচার ব্যবস্থায় নতুন দিগন্তের সূচনা হবে বলে মনে করছেন আইনজীবী এম এ মুনতাকিম। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, প্রচলিত নিয়মে কোনো অভিযুক্তকে দোষি সাব্যস্ত করা ও সাজা একই দিনে দেওয়া হয়ে থাকে। হাইকোর্টের নির্দেশনা অনুসারে এখন সাজা নির্ধারণের জন্য এখন থেকে পৃথক শুনানি করতে হবে। ফলে একই অপরাধের সাজার তারতম্য অনেকাংশেই কমে যাবে। পাশাপাশি ন্যায় বিচার প্রতিষ্ঠার পথ আরও সুগম হবে।
সাজা প্রদানে গাইডলাইনের প্রয়োজনীয়তা
২০২০ সালের ১ ডিসেম্বর দেওয়া এক রায়ে সাজা প্রদানে গাইডলাইনের (নির্দেশিকা) প্রয়োজনীয়তা উল্লেখ করেছেন আপিল বিভাগ। ‘আতাউর মৃধা বনাম রাষ্ট্র’ শিরোনামে এই মামলার রায়ে সংখ্যাগরিষ্ঠ মতামতে বলা হয়, সাজা বিষয়ে গাইডলাইনের অনুপস্থিতিতে বিস্তৃত বিচার–বিবেচনা শেষ পর্যন্ত অনিশ্চিত সাজা প্রদানের দিকে যায়। সাজা প্রদানের ক্ষেত্রে একটি বিধিবদ্ধ গাইডলাইন বা নির্দেশিকা প্রয়োজন। একইভাবে উপযুক্ত সাজা প্রদানের চ্যালেঞ্জিং কাজের জন্য যথাযথ আইনি কাঠামো প্রয়োজন।
রায়ে একজন বিচারপতি উল্লেখ করেন, অপরাধের সাজা নির্ধারণ করা বিচারকের জন্য সহজ কাজ নয়, যেখানে নাগরিকের জীবন বা স্বাধীনতার বিষয় সম্পর্কিত, কোনো অপরাধে দোষী সাব্যস্ত ব্যক্তির স্বার্থও সংবিধান ও আইন দিয়ে সুরক্ষিত। সাজা প্রদানে নির্দেশিকা না থাকায়, সাজার বিষয়ে বিচারকের সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষেত্রে অনেক সময় ব্যক্তিগত ধারণা ও দৃষ্টিভঙ্গি নির্ভর করে।
এরপর অভিন্ন ও সামঞ্জস্যপূর্ণ সাজার চর্চা নিশ্চিতে সাজা প্রদানে নির্দেশিকা বা নীতিমালা প্রণয়নের নির্দেশনা চেয়ে ২০২১ সালে হাইকোর্টে রিট করা হয়। এর প্রাথমিক শুনানি নিয়ে ২০২১ সালের ১৯ সেপ্টেম্বর হাইকোর্ট রুল দেন। রুলে আপিল বিভাগের রায়ের আলোকে অভিন্ন ও সামঞ্জস্যপূর্ণ সাজার চর্চা নিশ্চিত করতে সাজা প্রদানে নির্দেশিকা বা নীতিমালা প্রণয়ন করতে কেন নির্দেশ দেওয়া হবে না, তা জানতে চাওয়া হয়।
রিট আবেদনকারী আইনজীবী মোহাম্মদ শিশির মনির প্রথম আলোকে বলেন, আপিল বিভাগের ওই পর্যবেক্ষণ হাইকোর্টের রায়ে রয়েছে। সাজা দেওয়ার বিষয়ে পৃথক শুনানি করতে নির্দেশ দিয়েছেন হাইকোর্ট। এই রায়ের ফলে একই অপরাধে সাজা প্রদানের ক্ষেত্রে তারতম্য অনেকাংশেই নিরসন হবে। সাজা প্রদানে নির্দেশিকা বা নীতিমালা প্রণয়ন প্রশ্নে রুল চূড়ান্ত শুনানির জন্য অপেক্ষায়।