ইসিকে পত্রিকা ও অনলাইন প্রতিনিধিরা
গোপন নির্দেশনা নয়, নজরদারি ও সাইবার সক্ষমতা বাড়ানোর পরামর্শ
নিউজ ডেস্ক আদালত বার্তাঃ৬ অক্টোবর ২০২৫
নির্বাচন কমিশনের সংলাপে আসন্ন নির্বাচন সামনে রেখে পত্রিকা ও অনলাইন সম্পাদক এবং প্রতিনিধিরা নির্বাচন কমিশনের (ইসি) কাছে অবাধ, সুষ্ঠু, গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের জন্য নিজেদের প্রত্যাশা ও উদ্বেগের কথা তুলে ধরেছেন। সংলাপে নির্বাচনকালীন নিরাপত্তা, সাইবার নজরদারি, আর্থিক স্বচ্ছতা এবং সাংবাদিকদের প্রবেশাধিকারের মতো গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলো উঠে এসেছে।
সোমবার (০৬ অক্টোবর) বিকেলে আগারগাঁওয়ের নির্বাচন ভবনের সম্মেলন কক্ষে পত্রিকা ও অনলাইন সম্পাদক এবং প্রতিনিধিদের সঙ্গে সংলাপ শুরু করে নির্বাচন কমিশন। এতে প্রধান নির্বাচন কমিশনারসহ অন্য চার নির্বাচন কমিশনার ও ইসির উর্ধ্বতন কর্মকতারা উপস্থিত ছিলেন।
কালের কণ্ঠের সম্পাদক ও জাতীয় প্রেসক্লাবের সভাপতি হাসান হাফিজ নির্বাচন কমিশনের উদ্দেশ্যে বলেন, প্রত্যাশা থাকবে আপনারা মেরুদণ্ড সম্পন্ন ব্যক্তিত্ব হিসেবে জাতির কাছে পৌঁছাবেন। এটি দেশকে নতুন করে গড়ার একটি বিরল সুযোগ। যা হয়তো ৫০ বা ১০০ বছরে আসবে না। তিনি ইসির প্রস্তুতি ডু অর ডাই মনোভাব নিয়ে দৃঢ়তার পরিচয় দেওয়ার আহ্বান জানান।
অতীতের নির্বাচন পরিচালনাকারীরা এখন কাঠগড়ায় দাঁড়াচ্ছেন উল্লেখ করে তিনি বলেন, ইসির সামনেও একই ধরনের আশঙ্কা রয়েছে।
হাসান হাফিজ নির্বাচনকে গ্রহণযোগ্য করতে ইসির প্রতি কয়েকটি সুনির্দিষ্ট প্রস্তাব দেন। তিনি রাজনৈতিক নেতাকর্মীদের বাদ দিয়ে প্রতিটি নির্বাচনী এলাকায় পেশাজীবী, ব্যবসায়ী, তরুণ এবং গণ্যমান্য শিক্ষকদের নিয়ে একটি নজরদারি কমিটি গঠনের প্রস্তাব করেন। তার মতে, এটি নির্বাচন কমিশনের কাজ অনেকাংশে সহজ করবে এবং সবার মধ্যে দায়িত্ববোধ তৈরি হবে। এছাড়া তিনি সাইবার নজরদারি বাড়ানোর ওপর জোর দেন।
তিনি উল্লেখ করেন, এআই ব্যবহার করে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে নানা ধরনের প্রোপাগান্ডা ছড়ানো হচ্ছে। এ ব্যাপারে সক্ষমতা বাড়াতে প্রয়োজনে বিদেশি সহায়তা নেওয়ার পরামর্শ দেন তিনি।
প্রথম আলোর নির্বাহী সম্পাদক সাজ্জাদ শরিফ তার বক্তব্যে নির্বাচনের বিভিন্ন দিক নিয়ে গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করেন। তিনি বলেন, জাতি ১৫ বছর পর একটি স্বচ্ছ ও আনন্দময় নির্বাচনের অপেক্ষায় রয়েছে। তবে, এবারের নির্বাচনে অর্থ ও পেশিশক্তির ব্যাপক প্রয়োগের আশঙ্কা রয়েছে। তিনি প্রশাসনের দুর্বলতা ও আন্ডারহ্যান্ডলিংয়ের মাধ্যমে প্রার্থী কেনা-বেচার মতো বিষয়গুলো নিয়ে ইসির দৃষ্টি আকর্ষণ করেন।
সাজ্জাদ শরিফ বিশেষভাবে ডিজিটাল স্পেসে অর্থ প্রয়োগের মাধ্যমে জনমত তৈরির বিষয়টি তুলে ধরেন। তিনি বলেন, সাবেক ক্ষমতাসীন দল একটি বিরাট ডিজিটাল বাহিনী গড়ে তুলেছিল এবং এবারের নির্বাচনে এর ব্যাপক ব্যবহারের আশঙ্কা রয়েছে। তিনি হলফনামা ও নির্বাচনী ব্যয়ের স্বচ্ছতা নিশ্চিত করার ওপর জোর দিয়ে বলেন, ইসিকে দৃশ্যমান পদক্ষেপ নিতে হবে এবং দু-একটি ক্ষেত্রে নজির স্থাপন করে নৈতিক শক্তির পরিচয় দিতে হবে।
আজকের পত্রিকার সম্পাদক কামরুল হাসান প্রার্থীর হলফনামা দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই তা ওয়েবসাইটে আপলোড করার দাবি জানান। তিনি বলেন, এতে ভোটাররা প্রার্থীর সম্পর্কে যাবতীয় তথ্য দ্রুত জানতে পারবে। একই সঙ্গে তিনি নির্বাচন কমিশনকে কোনো ধরনের গোপন নির্দেশনা না দেওয়ার অনুরোধ করেন, যা স্বচ্ছ নির্বাচনের প্রতিশ্রুতিকে ক্ষুণ্ন করতে পারে।
দ্য ডেইলি স্টারের হেড অব নিউজ জিয়াউল হক ভোটকেন্দ্রে সাংবাদিকদের অবাধ প্রবেশ নিশ্চিত করার দাবি জানান। তিনি বলেন, সাংবাদিকরা যেন ভোটকেন্দ্রের ভেতরে কোনো ধরনের বাধা বা হয়রানির শিকার না হন এবং তাদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা হয়।
বাসস এর ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও প্রধান সম্পাদক মাহবুব মোর্শেদ বলেন, আমরা আশা করব, নির্বাচনের আগে যে অর্থের খেলা শুরু হয়-মনোনয়ন বাণিজ্য, ভোট কেনা, এমনকি কর্মকর্তাদের প্রভাবিত করার মতো কর্মকাণ্ড-এসব কঠোরভাবে বন্ধ করতে হবে। যারা এখন থেকেই ভাবছেন মনোনয়ন কিনবেন, ভোট কিনবেন, কিংবা প্রশাসনের কর্মকর্তাদের কিনে ফেলবেন, তাদের বিরুদ্ধে নির্বাচন কমিশনকে তফসিলের পর থেকেই আইন প্রয়োগ করতে হবে। তাহলেই আমরা অন্তত একটি অর্থবহ সংসদ পাবো।
তিনি বলেন, নির্বাচন যেন একদিনের ইভেন্ট না হয়, বরং একটি দীর্ঘমেয়াদী গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ার অংশ হোক-এ প্রত্যাশা আমাদের সবার। আমরা চাই না নির্বাচনের দিন ভোটের পরিবেশ ঠিক থাকলেও আগের রাতে অর্থের প্রভাবে জনমত বিকৃত হয়ে যাক। নির্বাচন কমিশন চাইলে এ জায়গায় দৃষ্টান্ত স্থাপন করতে পারে।
তিনি দুঃখ প্রকাশ করে বলেন, একদলীয় বা একতরফা নির্বাচনে যে সংসদ গঠিত হয়েছিল, সেসব সংসদে অনেক সদস্য ঘুমিয়ে সময় কাটিয়েছেন। আইন প্রণয়নে তাদের কোনো সক্রিয়তা ছিল না। দল যা বলেছে, সেটাই তারা হ্যাঁ বা না বলে সমর্থন করেছেন। ফলে জনগণের ইচ্ছার প্রতিফলন সংসদে অনুপস্থিত ছিল।
বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম-এর সম্পাদক তৌহিদুল ইসলাম মিন্টু বলেন, আমরা যে আশংকার কথা প্রকাশ করছি, যে নির্বাচন হবে কি হবে না, সেটা আসলে রাজনৈতিক বিষয়। রাজনৈতিক সিদ্ধান্তের ওপর নির্ভর করে নির্বাচনটা কীভাবে হবে। রাজনৈতিক ক্ষমতাই ইসির ক্ষমতাকে নির্ধারণ করে। গত তিন টার্মে সেটাই হয়েছে। যে কারণে সুষ্ঠু নির্বাচন হয়নি বা করতে পারেনি।
তিনি বলেন, এই সরকারের বা নির্বাচন কমিশনের সুযোগটা রয়েছে, যে তার ওপর কোনো অর্পিত দায়িত্ব নেই। যে সরকার ক্ষমতায় রয়েছে, তাদের আগামী নির্বাচন করার ইচ্ছা নেই বা ক্ষমতায় আসার ইচ্ছা নেই। তাই অবাধ, নিরপেক্ষ নির্বাচন করার ক্ষেত্রে নির্বাচন কমিশনের কোনো বাধা নেই। এখন যারা নির্বাচনে অংশীজন, তারা কীভাবে অংশ নেবে তার ওপর আগামী নির্বাচন নির্ভর করবে।
ঢাকা মেইলের নির্বাহী সম্পাদক হারুন জামিল বলেন, বিগত তিনটা নির্বাচন ভোটার ছাড়া নির্বাচন হওয়ার কারণে নির্বাচনের ওপরে মানুষের আস্থা নষ্ট হয়ে গেছে। এ আস্থা ফিরিয়ে আনতে পারলে নির্বাচন কমিশন সফল হবে। আমাদের দেশে নির্বাচন ব্যবস্থার সবচেয়ে বড় সমস্যা হলো গত তিনটা নির্বাচন মানে ভোটার ছাড়া নির্বাচন হওয়ার কারণে নির্বাচনের উপরে মানুষের আস্থা নষ্ট হয়ে গেছে। নির্বাচন কমিশনের প্রথমেই উচিত হবে জনগণের রাস্তা ফিরে আনার জন্য অবাধ সুষ্ঠু নিরপেক্ষ নির্বাচনের আয়োজন করা।