ঐতিহাসিক চেতনা আর প্রজন্মের প্রেরণার অন্যান্য নাম মধুর ক্যান্টিন।
বিশেষ প্রতিবেদন,আদালত বার্তাঃ১৭ জুলাই ২০২৫
একটা ছোট্ট ক্যান্টিন, অথচ নামের পিছনে রয়েছে বড় ইতিহাস। কেবল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের কাছেই নয়, দেশের সচেতন নাগরিক মাত্রেই “মধুর ক্যান্টিন” নামটি এক গর্বিত শিহরণ জাগায়। এ নিছক কোনো খাবারের স্থান নয়, এটি একটি আন্দোলনের চারণভূমি, তরুণদের জেগে ওঠার প্রতীক, আর এক বর্ণাঢ্য ঐতিহ্যের জীবন্ত প্রহরী।
বাঙালির ভাষা আন্দোলন থেকে শুরু করে স্বাধিকার ও স্বাধীনতা সংগ্রাম সব ইতিহাসের পাতায় পাতায় জড়িয়ে আছে এই ক্যান্টিনের নাম। ১৯৫২ থেকে ১৯৭১ পর্যন্ত যে তরুণরা রাজপথ কাঁপিয়েছেন, তাঁদের বহু পদক্ষেপের সূচনা হয়েছিল এই ক্যান্টিনের টেবিলে। চায়ের কাপের টুংটাং শব্দের সঙ্গে ঘূর্ণি তুলত রাজনৈতিক আলোচনা, গড়ে উঠত সিদ্ধান্ত, আর বেরিয়ে যেত একেকটি রণকৌশল।
মধুর ক্যান্টিনের যাত্রা শুরু হয় ১৯২১ সালে, যখন মধুসূদন দে নামের এক তরুণ তাঁর বাবার সঙ্গে ঢাকায় এসে একটি ছোট ক্যান্টিন চালু করেন। সমাজ ও রাজনীতিতে সক্রিয় এই মানুষটি এক সময় হয়ে ওঠেন ছাত্ররাজনীতির বন্ধু। তাঁর ক্যান্টিন হয়ে ওঠে মুক্তচিন্তার অভয়াশ্রম। আর তাতেই চক্ষুশূল হয়ে ওঠেন হানাদার বাহিনীর। ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ রাতে পাকিস্তানি বাহিনী তাঁকে জগন্নাথ হল থেকে ধরে নিয়ে যায় এবং নির্মমভাবে হত্যা করে। স্বাধীনতার পর তাঁর ছেলে অরুণ কুমার দে ক্যান্টিনের দায়িত্ব নেন।
ক্যান্টিনের বর্তমান ভবনটিও কম ইতিহাস বহন করে না। আঠারো শতকের শেষভাগে নবাবদের বৈঠকখানা ও নৃত্যশালা হিসেবে তৈরি এই ভবনটি একসময় ‘দরবার হল’ নামে পরিচিত ছিল। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার পর এই ভবনটি তার আওতায় চলে আসে। এখন এখানে রয়েছে মধুসূদন দে-র স্মরণে একটি ভাস্কর্য, যা ইতিহাস স্মরণের এক নিঃশব্দ সাক্ষী।
প্রশ্ন উঠতে পারে, এখানে এমন কী খাবার মেলে যা এত জনপ্রিয়? উত্তরটা সরল: খাবার যত না মুখরোচক, তার চেয়ে বেশি হৃদয়ছোঁয়া পরিবেশ। শিঙাড়া, সমুচা, চা এসবই এখানে বিশেষ হয়ে ওঠে বন্ধুত্বের হাসি আর বিতর্কের উত্তাপে। বসার জায়গাও পর্যাপ্ত, আর পরিবেশ বেশ স্বস্তিদায়ক। এখানে শুধু বর্তমান নয়, আগের প্রজন্মের ছাত্ররাও এসে জড়ো হন। জীবনের বাস্তবতায় ক্লান্ত হয়ে অনেকেই ফিরে আসেন কিছু স্মৃতির টানে।
মধুর ক্যান্টিন এখন শুধু বিশ্ববিদ্যালয়ের গণ্ডিতে সীমাবদ্ধ নয়। বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ছাত্রছাত্রীরাও এখানে এসে বসেন, কথা বলেন, ভাবেন, কখনো তর্ক করেন, কখনো গান ধরেন। তবে মনে রাখতে হবে, মত প্রকাশের স্বাধীনতা সবার, তাই নিজের মত দিতে গিয়ে অন্যের মতকে অশ্রদ্ধা করা অনুচিত। বিব্রতকর পরিস্থিতি এড়িয়ে সুন্দর আলোচনায় গড়ে উঠুক নতুন দিনের নতুন দর্শন।
তথ্যসূত্র: এনটিভি অনলাইন।