পিআর নির্বাচন পদ্ধতি কী? প্রচলিত ব্যবস্থার সঙ্গে পার্থক্য কোথায়।
নিউজ ডেস্ক আদালত বার্তা : ৩০ জুন ২০২৫
গণতন্ত্রে জনগণের মতামতের যথাযথ প্রতিফলন নিশ্চিতে আনুপাতিক প্রতিনিধিত্বভিত্তিক নির্বাচন বা পিআর (Proportional Representation) পদ্ধতির প্রয়োজনে নতুন করে গুরুত্ব পাচ্ছে বাংলাদেশে। ৫ আগস্ট ২০২৪-এর পর হাসিনা সরকারের পতনের মাধ্যমে পাল্টে যাওয়া রাজনৈতিক বাস্তবতায় অন্তর্বর্তীকালীন সরকার নির্বাচনী ব্যবস্থার সংস্কারে উদ্যোগ নিয়েছে, যার আলোচ্য বিষয়ের অন্যতম এই পিআর পদ্ধতি।
বর্তমান ‘ফার্স্ট পাস্ট দ্য পোস্ট’ (FPTP) পদ্ধতিতে একটি দল ২৫-৩০ শতাংশ ভোট পেয়েও বিপুল আসনে জিততে পারে, আবার অন্য দল ৪০ শতাংশের বেশি ভোট পেয়েও মাত্র হাতে গোনা কয়েকটি আসন পেতে পারে। এই বৈষম্য থেকে বের হয়ে একটি ভারসাম্যপূর্ণ ও ন্যায্য প্রতিনিধিত্ব গঠনের লক্ষ্যে পিআর ব্যবস্থা চালুর দাবি তুলেছে জাতীয় পার্টি, জামায়াতে ইসলামী, ইসলামী আন্দোলন, কমিউনিস্ট পার্টিসহ আরও কয়েকটি রাজনৈতিক দল। তবে বিএনপি এখনও প্রচলিত সংসদীয় পদ্ধতির পক্ষেই রয়েছে।
কী এই পিআর পদ্ধতি
আনুপাতিক প্রতিনিধিত্বভিত্তিক নির্বাচন ব্যবস্থা এমন একটি পদ্ধতি যেখানে রাজনৈতিক দল বা জোট যত শতাংশ ভোট পায়, তারা সংসদে তত শতাংশ আসন পায়। উদাহরণস্বরূপ, কোনো দল যদি ১০% ভোট পায়, তবে তারা সংসদের ১০% আসন পাবে। এতে ভোটের প্রতিফলন সংসদে সরাসরি দেখা যায়।
বিশ্বজুড়ে ৯১টিরও বেশি দেশ, অর্থাৎ ৫৪ শতাংশ গণতান্ত্রিক দেশ, বর্তমানে এই পদ্ধতিতে নির্বাচন পরিচালনা করছে। উন্নত বিশ্বের সংগঠন ওইসিডি’র অন্তর্গত ৩৬ দেশের মধ্যে ২৫টিতেই রয়েছে এই পদ্ধতি।
প্রচলিত পদ্ধতির সীমাবদ্ধতা
বাংলাদেশে বর্তমানে চালু রয়েছে FPTP পদ্ধতি। এতে সবচেয়ে বেশি ভোট পাওয়া প্রার্থীই জয়ী হন, বাকিদের ভোট কার্যত ‘নষ্ট’ হয়ে যায়। উদাহরণস্বরূপ, একটি আসনে চারজন প্রার্থী থাকলে এবং একজন মাত্র ২৫% ভোট পেলেও তিনজন মিলে ৭৫% পেলেও বিজয়ী হন সেই ২৫% ভোট পাওয়া প্রার্থীই। এতে অধিকাংশ ভোটারের মত সংসদে প্রতিফলিত হয় না।
২০০১ সালে বিএনপি ৪০.৮৬% ভোট পেয়ে ১৯৩টি আসন পেলেও, আওয়ামী লীগ ৪০.২২% ভোট পেয়ে মাত্র ৬২টি আসন পেয়েছিল। আবার ২০০৮ সালে আওয়ামী লীগ ৪৮% ভোটে ২৩০টি আসন পেয়েছিল, বিপরীতে বিএনপি ৩২% ভোট পেয়ে মাত্র ৩০টি আসন পেয়েছিল। এই চিত্রগুলো স্পষ্ট করে যে, সংসদে আসন বরাদ্দ অনেক সময়ই জনগণের প্রকৃত রায়ের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ থাকে না।
পিআর পদ্ধতির ধরন
বিশ্বে মূলত তিন ধরনের পিআর পদ্ধতি চালু রয়েছে:
মুক্ত তালিকা পদ্ধতি: ভোটের ভিত্তিতে দল তালিকাভুক্ত প্রার্থীদের থেকে আসন পায়।
বদ্ধ তালিকা পদ্ধতি: দল ঠিক করে দেয়, কোন প্রার্থীরা সংসদে যাবে।
মিশ্র পদ্ধতি: কিছু আসনে সরাসরি প্রতীকভিত্তিক ভোট, বাকিতে পিআর ভিত্তিক।
বিশেষজ্ঞদের মত
নির্বাচন বিশ্লেষক অধ্যাপক তোফায়েল আহমেদ বলেন, সংসদে যেসব দলের আসন নেই, পিআর চালু হলে তাদেরও অংশগ্রহণ নিশ্চিত হবে। এতে সুশাসনও প্রতিষ্ঠা পাবে।
রাজনৈতিক বিশ্লেষক মহিউদ্দিন আহমদ বলেন, অনেক সময় ১০-১৫% জাতীয় ভোট পাওয়া দল সংসদে কোনো আসনই পায় না। পিআর চালু হলে এমন বৈষম্য কমে যাবে এবং গণতন্ত্র হবে আরও অন্তর্ভুক্তিমূলক।
বাধা কোথায়
আনুপাতিক ভোটিং ব্যবস্থার পক্ষে রাজনৈতিক ঐকমত্য এখনও স্পষ্ট নয়। বিএনপি এই পদ্ধতির বিরোধিতা করছে। তাঁদের যুক্তি, এতে রাজনৈতিক অস্থিরতা ও জোটনির্ভর সরকার গঠনের ঝুঁকি থাকে। তবে বিশ্লেষকরা বলছেন, জাতীয় ঐকমত্য তৈরি হলে ধাপে ধাপে পিআর বাস্তবায়ন সম্ভব।