সাবেক প্রধান বিচারপতি এ বি এম খায়রুল হকের জামিন ও মামলা বাতিল আবেদনের শুনানিতে আসামিপক্ষের ও রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবীদের মধ্যে হট্টগোল
নিউজ ডেস্ক আদালত বার্তা : ১১ আগস্ট ২০২৫
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনকে কেন্দ্র করে রাজধানী ঢাকার যাত্রাবাড়ীতে যুবদলকর্মী আবদুল কাইয়ুম আহাদ হত্যা মামলায় সাবেক প্রধান বিচারপতি এ বি এম খায়রুল হকের জামিন ও মামলা বাতিল আবেদনের শুনানিতে আসামিপক্ষের ও রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবীদের মধ্যে হট্টগোল ও ধাক্কাধাক্কির ঘটনা ঘটেছে।
সোমবার (১১ আগস্ট) দুপুরে বিচারপতি শেখ জাকির হোসেন ও বিচারপতি কে এম রাশেদুজ্জামান রাজার সমন্বয়ে গঠিত হাইকোর্ট বেঞ্চের এজলাস কক্ষে এই হট্টগোলের ঘটনা ঘটে।
এ সময় রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবীরা আসামিপক্ষের আইনজীবীদের উদ্দেশ্যে বলেছেন, ‘তারা বিচার বিভাগকে ধ্বংস করে এখন মায়া কান্না দেখাতে এসেছেন। সাবেক প্রধান বিচারপতি এস কে সিনহাকে যখন দেশ থেকে বের করে দেওয়া হয়েছিল, তখন আপনারা কোথায় ছিলেন।’
পরে আদালত রাষ্ট্রপক্ষের আবেদন মঞ্জুর করে আগামী ১৭ আগস্ট এ মামলার পরবর্তী শুনানির দিন ধার্য করেছেন।
জানা গেছে, খায়রুল হকের বিরুদ্ধে যাত্রাবাড়ী থানায় করা হত্যা মামলা বাতিল ও জামিন চেয়ে গত রোববার আবেদন করা হয়। এই আবেদনের ওপর আজ দুপুরে শুনানি হওয়ার কথা ছিল।
দুপুরের পর বিচারক এজলাসে ওঠার আগেই খায়রুল হকের পক্ষে শুনানিতে অংশ নিতে এজলাসে উপস্থিত হন সিনিয়র আইনজীবী এম কে রহমান, সিনিয়র আইনজীবী মহসিন রশিদ, সিনিয়র আইনজীবী জেড আই খান পান্না, সিনিয়র আইনজীবী মনসুরুল হক চৌধুরী, মোতাহার হোসেন সাজু, সৈয়দ মামুন মাহবুবসহ অনেকেই।
বিচারক এজলাসে ওঠার পর রাষ্ট্রপক্ষ থেকে বলা হয়, গুরুত্বপূর্ণ এ মামলার শুনানিতে রাষ্ট্রের প্রধান আইন কর্মকর্তা (অ্যাটর্নি জেনারেল) অংশ নেবেন। পরে আদালত ৩টার মধ্যে অ্যাটর্নি জেনারেলকে আসতে বলেন। তখন ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল রাসেল আহমেদ অ্যাটর্নি জেনারেলের সঙ্গে যোগাযোগ করেন।
তিনটার দিকে ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল আদালতকে জানান, অ্যাটর্নি জেনারেল এ মামলায় এক সপ্তাহ সময় চেয়েছেন। তখন আসামিপক্ষের আইনজীবীরা দাঁড়িয়ে বলেন, ‘আমরা এখানে চার-পাঁচজন আছি, যাদের বয়স ৭৫ বছরের ওপরে। সবাই শুনানি করার জন্য অপেক্ষা করছি। আজ শুনানি হবে না কেন? শুনানি করে রুল জারি করেন।’
এসময় আসামিপক্ষে আইনজীবী এম কে রহমান ও মহসিন রশিদ আদালতকে বলেন, ‘সাবেক প্রধান বিচারপতিকে পিঠমোড়া দিয়ে বেঁধে আনা-নেওয়া করা হচ্ছে। আসামিকে রিমান্ডে না পাঠানোয় তদন্তকারী কর্মকর্তাকে ব্যাখ্যা দিতে বলা হয়েছে। আমরা কোন আদালতে আছি? এমন বিচার বিভাগ কখনো দেখিনি। আমরা জুডিশিয়ারিকে রক্ষা করতে এসেছি।’
তখন রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবীরা বলেন, ‘খায়রুল হকের মতো কুলাঙ্গার এই জুডিশিয়ারিতে আর আসে নাই। সে এই বিচার বিভাগকে ধ্বংস করেছে। দেশের যে পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে, সেটা শুধু তার জন্যই হয়েছে। আপনারা সাবেক প্রধান বিচারপতি এসকে সিনহাকে যখন দেশ থেকে বের করে দেওয়া হয়েছিল, তখন কোথায় ছিলেন। তখন তো কোনো সিনিয়র কথা বলেননি। এখন কেন মায়াকান্না দেখাতে আসছেন। তখন মায়াকান্না কোতায় ছিল।’
এ সময় সহকারী অ্যাটর্নি জেনারেল মো. উজ্জ্বল হোসেন আদালতকে বলেন, ‘আমি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র ছিলাম। ছাত্র থাকাবস্থায় আমার বিরুদ্ধে ৮টি মামলা হয়েছে। তখন আপনারা সিনিয়ররা কোথায় ছিলেন। কেউ তো আমার পক্ষে এসে দাঁড়াননি।’
একপর্যায়ে ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল আদালতকে বলেন, ‘আজ শুনানি হবে না। এক সপ্তাহ পর শুনানির দিন ধার্য করেন।’
এসময় এম কে রহমান বলেন, ‘আদালতকে ডিকটেক্ট করবেন না।’
তখন রাষ্ট্রপক্ষের আইন কর্মকর্তারা একযোগে এর প্রতিবাদ জানান। আস্তে আস্তে এজলাস কক্ষে হট্টগোলের সৃষ্টি হয়। আসামিপক্ষের একজন আইনজীবীকে ধাক্কাও মারতে দেখা যায়। পরে আদালত আগামী ১৭ আগস্ট বেলা ১১টায় এ মামলার শুনানির সময় নির্ধারণ করেন।
প্রসঙ্গত, গত ২৪ জুলাই সকালে ধানমন্ডির বাসা থেকে খায়রুল হককে গ্রেপ্তার করে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ। ওইদিন রাতে তাকে কারাগারে পাঠানো হয়। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন চলাকালে আব্দুল কাইয়ূম হত্যার অভিযোগে রাজধানীর যাত্রবাড়ী থানায় করা মামলায় তাকে গ্রেপ্তার দেখানো হয়। পরে পুলিশের আবেদনের প্রেক্ষিতে সেদিন রাতে তাকে কারাগারে আটক রাখার আদেশ দেন।
জানা যায়, ২০১০ সালের ৩০ সেপ্টেম্বর প্রধান বিচারপতি হিসাবে শপথগ্রহণ করেন খায়রুল হক। প্রধান বিচারপতি থাকাকালে সাবেক প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের শাসনামলের বৈধতাদানকারী সংবিধানের পঞ্চম সংশোধনী বাতিলের মাধ্যমে সাংবিধানিক শূন্যতার সূচনা করেন তিনি। এরপর খায়রুল হক অবসরে যাওয়ার মাত্র এক সপ্তাহ আগে ২০১১ সালের ১০ মে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থার বিধান সংবলিত সংবিধানের ত্রয়োদশ সংশোধনী বাতিল করে রায় দেন। অথচ তখন সুপ্রিমকোর্টের আটজন অ্যামিকাস কিউরির (আদালতকে আইনগত পরামর্শদানকারী) মধ্যে পাঁচজনই তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বহালের পক্ষে মতামত দিয়েছিলেন। তাদের মতামত উপেক্ষা করেই তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাতিল করে রায়ের পক্ষে ছিলেন খায়রুল হকসহ চার বিচারপতি। আর তিনজন বিচারপতি তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাতিলের বিপক্ষে রায় দিয়েছিলেন।
এ ছাড়া সংক্ষিপ্ত রায়ে পরবর্তী আরও দুটি নির্বাচন তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থার মাধ্যমে অনুষ্ঠানের কথা বলেছিলেন বিচারপতি খায়রুল হকের নেতৃত্বাধীন বেঞ্চ। কিন্তু ওই রায় প্রকাশের আগেই ২০১১ সালের ৩০ জুন আওয়ামী লীগ সরকার তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থার বিধান বাতিল করে সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনী আইন পাস করেন। এক বছর চার মাস পরে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাতিল করে আপিল বিভাগের দেওয়া পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশিত হয়। অবসরে যাওয়ার দীর্ঘদিন পর দেওয়া তার পূর্ণাঙ্গ রায়ে পরবর্তী দুটি নির্বাচন তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থার অধীনে হতে পারে বলে দেওয়া অংশটুকু আর ছিল না। তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থার বিধান বাতিল করে দেওয়া রায়ের ফলে বিগত সরকারের আমলে দেশের নির্বাচন ব্যবস্থা এবং গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া ধ্বংস হয় বলে মনে করেন বিশ্লেষকরা।