পবিত্র ঈদুল ফিতরের পর শ্রমিক দিবস উপলক্ষে আয়োজিত সমাবেশটিকেও গুরুত্বের সঙ্গে নেওয়া হয়েছে। ব্যাপক লোকসমাগম ঘটিয়ে ঈদের পর আন্দোলন শুরুর প্রথম মহড়া ভালোভাবে শুরু করতে চায় বিএনপি।
দলীয় সূত্রে জানা গেছে, নতুন কর্মসূচিতে তারা আবারও বিভাগীয় পর্যায়ে কর্মসূচি নিয়ে যেতে চায়। এর আগে সারা দেশের বিভাগীয় সমাবেশগুলোতে ব্যাপক লোকসমাগম ঘটিয়ে গণজাগরণ সৃষ্টি করেছিল দলটি। কিন্তু পরে নয়াপল্টনের ধরপাকড়ের পর নানা কারণে কর্মসূচি দিয়ে আর তেমন সাড়া ফেলতে পারেনি। তাই এবার সেই তৃণমূল দিয়েই আন্দোলন জমানোর পরিকল্পনা চলছে।
দলের নেতারা জানান, সারা দেশে সভা-সমাবেশের মাধ্যমে যেভাবে তারা গণজাগরণ সৃষ্টি এবং জনসম্পৃক্ততা ঘটাতে পেরেছিলেন, তাতে অনেকটাই ছেদ ঘটে ৭ ডিসেম্বর নয়াপল্টনে সংঘর্ষের ঘটনায়। যদিও এর পরে ধারাবাহিক কর্মসূচির মাধ্যমে রাজপথে নিজেদের অবস্থান ধরে রেখেছেন তারা। কিন্তু সরকার পতনের এক দফার আন্দোলনের জন্য তাদের আবারও জনমত তৈরির কর্মসূচিতে যেতে হবে। জনগণকে মাঠে নামাতে হবে। বিভিন্ন রাজনৈতিক দল, পেশাজীবী, সুশীল আর বুদ্ধিজীবীদের সক্রিয় করতে হবে। এ লক্ষ্যে আবারও একেবারে তৃণমূল থেকে শুরু করতে চাইছে বিএনপির হাইকমান্ড।
সরকারবিরোধী চূড়ান্ত আন্দোলনের আগে আবারও তৃণমূলে যাচ্ছে বিএনপি। নির্দলীয় সরকারের অধীনে আগামী জাতীয় নির্বাচনের দাবি আদায়ে নিজেদের আরো শক্তিশালী ও সুসংহত করতে চায় দলটি। এক দফার আন্দোলনে যাওয়ার আগে তৃণমূল পর্যায়ে ইস্যুভিত্তিক ধারাবাহিক কর্মসূচি দেবে দলটি। আন্দোলনে জনসম্পৃক্ততা বাড়ানোর পাশাপাশি দাবির পক্ষে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের কাছেও নিজেদের শক্তি জানান দিতে চায় দলটির হাইকমান্ড। লক্ষ্য অর্জনে গ্যাস-বিদ্যুৎসহ নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির প্রতিবাদে চলমান কর্মসূচি আরও কিছুদিন অব্যাহত রাখার সিদ্ধান্ত নিয়েছে বিএনপিসহ সমমনা বিরোধী দলগুলো। একেবারে তৃণমূল থেকে সভা-সমাবেশ, মানববন্ধন, গণঅবস্থান, গণসমাবেশ, সমাবেশ, পথযাত্রার মতো কর্মসূচি পালনের মাধ্যমে জেলা ও বিভাগীয় পর্যায়ে ‘বড় সমাবেশ’ করার পরিকল্পনা রয়েছে বিএনপির।
সংবিধান অনুযায়ী আগামী ডিসেম্বর অথবা জানুয়ারির প্রথম সপ্তাহে অনুষ্ঠিত হবে দ্বাদশ সংসদ নির্বাচন। সে অনুযায়ী সেপ্টেম্বর বা অক্টোবরে ঘোষণা হতে পারে নির্বাচনের তফসিল। তফসিলের আগের চার মাসের মধ্যেই আন্দোলনের ফসল ঘরে তুলতে চায় টানা ১৬ বছর ক্ষমতার বাইরে থাকা বিএনপি। সে লক্ষ্যে আগামী দু-তিন মাসে তৃণমূল থেকে আন্দোলনের ঢেউ তুলতে চায় তারা। তারপর ঢাকাসহ সারা দেশের রাজপথে চূড়ান্ত আন্দোলনের পরিকল্পনা করছে ২০১৪ ও ২০১৮ সালের নির্বাচনের আগে একই ইস্যুতে আন্দোলনে ব্যর্থ বিরোধী দলটি।
এ বিষয়ে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেন, তাদের আন্দোলন বিএনপিকে ক্ষমতায় নেওয়ার জন্য নয়। দেশের গণতন্ত্র ফিরিয়ে আনতে, জনগণের ভোটাধিকার ফিরিয়ে আনতে, মানুষের বেঁচে থাকার অধিকার ফিরে পেতে তারা আন্দোলন করছেন। এ আন্দোলনে যেমন বিএনপিসহ সব বিরোধী দলের নেতাকর্মী রাজপথে আছেন, তেমনি সাধারণ মানুষও আছেন। আগামীতে জনগণের সম্পৃক্ততা আরো বেশি বাড়াতে তারা কাজ করছেন। তাদের সমর্থনেই চলমান আন্দোলন সফল হবে।
সরকারের পদত্যাগ দাবিতে দীর্ঘদিন ধরে রাজপথে আন্দোলন করছে বিএনপি। ওই আন্দোলনে দেশের বিভিন্ন জেলায় ১৭ নেতাকর্মী নিহত হন, আহত হন অনেকে। কারাগারেও যেতে হয়েছে বিপুলসংখ্যক নেতাকর্মীকে। জ্বালানি তেল ও নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধি, দলীয় কর্মসূচিতে গুলি করে নেতাকর্মী হত্যার প্রতিবাদ, বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার মুক্তি এবং নির্বাচনকালীন নির্দলীয়-নিরপেক্ষ সরকারের দাবিতে ধারাবাহিক ওই আন্দোলনের অংশ হিসেবে সারাদেশে বিভাগীয় পর্যায়ে সমাবেশ করে দলটি। সরকারের বিভিন্ন বাধা-বিপত্তি উপেক্ষা করে এসব সমাবেশ সফল করলেও ১০ ডিসেম্বর ঢাকা বিভাগীয় সমাবেশকে কেন্দ্র করে পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষের ঘটনায় কিছুটা ঝিমিয়ে পড়ে দলটি।
তবে আন্দোলনের অংশ হিসেবে রমজান মাসে কর্মসূচির মাধ্যমে সক্রিয় থাকার চেষ্টা করে দলটি। সারাদেশে ইউনিয়ন থেকে শুরু করে থানা-উপজেলা, জেলা পর্যায়ে গণঅবস্থান, মানববন্ধন, প্রচারপত্র বিলির মতো কর্মসূচি পালন করেন নেতাকর্মী। এর বাইরে সারাদেশে শতাধিক ইফতার মাহফিলের আয়োজন করা হয়। দলের বিভিন্ন অঙ্গ সংগঠনের ব্যানারেও ইফতার মাহফিলের আয়োজন করা হয়। এর মাধ্যমে সরকারের দুর্নীতি, অনিয়ম, লুটপাট, বিদেশে টাকা পাচারসহ অন্যান্য অসংগতি তুলে ধরে দলটি। ইফতারে দলের নেতাকর্মী ছাড়াও পেশাজীবী, সর্বস্তরের মানুষের উপস্থিতিও ছিল লক্ষণীয়। এ ছাড়া গুম, খুন আর নির্যাতনের শিকার নেতাকর্মীর পাশে দাঁড়ানোর কর্মসূচিও গ্রহণ করে। কারাগারে আটক নেতাকর্মীকে সাহস জোগাতে কেন্দ্রীয় নেতারা ছুটে যান তাদের বাড়ি। দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের ঈদ উপহার পৌঁছে দেন তারা। এর মাধ্যমে নেতাকর্মীর মনোবল আরো সুদৃঢ় করার উদ্যোগ নেয় দলটি।
দলের একজন স্থায়ী কমিটির সদস্য জানান, সরকারবিরোধী চূড়ান্ত আন্দোলনের জন্য নিজেদের প্রস্তুতি সম্পর্কে আলোচনা চলছে। নেতাকর্মীকে সক্রিয় রাখার পাশাপাশি কোন কোন জায়গায় কী ধরনের দুর্বলতা রয়েছে, তা চিহ্নিত করা হচ্ছে। এসব ক্ষেত্রে সক্ষমতা বাড়ানোরও উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে। যেসব জায়গায় কোন্দল, নেতৃত্বশূন্যতা ও প্রতিবন্ধকতা রয়েছে, সেসব জায়গায় কীভাবে দুর্বলতা দূর করা সম্ভব, তা নিয়ে পরিকল্পনা নেওয়া হচ্ছে। সবকিছু সম্পন্ন করেই তারা এক দফার আন্দোলনে নামতে চান।
শুধু দলের সাংগঠনিক সক্ষমতা নয়; অন্যান্য দলের মতামত, তাদের চাওয়া-পাওয়াকে সমন্বয় করা হচ্ছে। কূটনৈতিক মহল, প্রশাসন- সর্বত্র তাদের কাজ চলছে। সবকিছু গুছিয়ে তারা চূড়ান্ত আন্দোলনে যাবেন। এ জন্য তাদের নিয়মতান্ত্রিক আন্দোলন চলমান থাকবে। সবকিছু ঠিক থাকলে চূড়ান্ত আন্দোলনের রোডম্যাপ ঠিক করা হবে বলে জানান সংশ্লিষ্ট নেতারা।
জানা গেছে, আগামীর আন্দোলনের জন্য সর্বাপেক্ষা গুরুত্বপূর্ণ ঢাকা মহানগর উত্তর ও দক্ষিণ।