১৯৯৪: সংসদ থেকে পদত্যাগপত্র গ্রহণ করেননি বিএনপির স্পিকার।
প্রতিবেদকের নাম:
-
প্রকাশিত:
রবিবার, ১১ ডিসেম্বর, ২০২২
-
৫৯৬
বার পড়া হয়েছে
১৯৯৪: সংসদ থেকে পদত্যাগপত্র গ্রহণ করেননি বিএনপির স্পিকার।
ডেস্ক নিউজ আদালত বার্তাঃ১১ ডিসেম্বর ২০২২।
১৯৯৪-সংসদ-থেকে-পদত্যাগপত্র-গ্রহণ-করেননি-বিএনপির-স্পিকারবিএনপির মেয়াদে নির্বাচনকালীন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবিতে আন্দোলনে থাকা আওয়ামী লীগের সংসদ সদস্যরা ১৯৯৪ সালের ২৮ ডিসেম্বর একযোগে পদত্যাগ করার পর দেশব্যাপী আন্দোলন ছড়িয়ে পড়ে। ছবি কোলাজ: নিউজবাংলা
১৯৯৪ সালের ২০ মার্চ মাগুরা-২ আসনের উপনির্বাচনে ব্যাপক কারচুপির অভিযোগ ওঠার পর পর জাতীয় নির্বাচন পরিচালনা করতে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবি সামনে আনে আওয়ামী লীগ। জুনে প্রকাশ করা হয় তত্ত্বাবধায়কের রূপরেখা। দাবি মেনে নেয়ার ঘোষণা দিতে সময় বেঁধে দেয়া হয় ২৭ ডিসেম্বর পর্যন্ত। বেঁধে দেয়া সময়সীমা পার হওয়ার পরদিনই পদত্যাগপত্র জমা দেন ১৪৭ জন সংসদ সদস্য। সেই পদত্যাগপত্র গ্রহণ হয়নি।
জাতীয় সংসদ থেকে পদত্যাগের যে ঘোষণা বিএনপি দিয়েছে, ঠিক একই ঘটনা ঘটেছিল ঠিক ২৮ বছর আগে। তবে সে সময় বিএনপির স্পিকার শেখ রাজ্জাক আলী সেই পদত্যাগপত্র গ্রহণ না করে সাত মাস সংসদ চালিয়ে গেছেন।
নির্বাচনকালীন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবিতে আন্দোলনে থাকা আওয়ামী লীগের সংসদ সদস্যরা ১৯৯৪ সালের ২৮ ডিসেম্বর একযোগে পদত্যাগ করেন। একই দাবিতে জাতীয় পার্টি এবং জামায়াতে ইসলামীর সংসদ সদস্যরাও একই পথে হাঁটেন। শুরু হয় জোরালো আন্দোলন।
তবে ক্ষমতায় থাকা বিএনপি বিরোধী দলের এই আন্দোলনকে পাত্তা না দিয়ে একতরফা নির্বাচনের দিকে এগিয়ে যায়।
১৯৯৪ সালের ২০ মার্চ মাগুরা-২ আসনের উপনির্বাচনে ব্যাপক কারচুপির অভিযোগ ওঠার পর পর জাতীয় নির্বাচন পরিচালনা করতে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবি সামনে আনে আওয়ামী লীগ। জুনে প্রকাশ করা হয় তত্ত্বাবধায়কের রূপরেখা। দাবি মেনে নেয়ার ঘোষণা দিতে সময় বেঁধে দেয়া হয় ২৭ ডিসেম্বর পর্যন্ত।
কিন্তু ক্ষমতাসীন দল বিএনপির নেতারা বিরোধী দলের দাবি নিয়ে তুচ্ছতাচ্ছিল্য করতে থাকেন। বলেন, তত্ত্বাবধায়কের দাবি কোনোভাবেই মেনে নেয়া হবে না।
বেঁধে দেয়া সময়সীমা পার হওয়ার পরদিনই পদত্যাগপত্র জমা দেন ১৪৭ জন সংসদ সদস্য। দেশের ইতিহাসে এটাই সবচেয়ে বড় পদত্যাগের ঘোষণা।
সংবিধান অনুযায়ী সদস্যরা পদত্যাগপত্র জমা দিলেই তা কার্যকর হয়ে যাওয়ার কথা। তবে সে সময় এই বিধানও লঙ্ঘন করার অভিযোগ ওঠে।
১৯৯৪: সংসদ থেকে পদত্যাগপত্র গ্রহণ করেননি বিএনপির স্পিকার
পদত্যাগপত্র গ্রহণ না করে স্পিকার শেখ আবদুর রাজ্জাক তাদের অনুপস্থিত হিসেবে বিবেচনা করার সিদ্ধান্ত দেন।
সংবিধানে এও আছে যে সংসদ সদস্যরা টানা ৯০ কার্যদিবস অনুপস্থিত থাকলে আসন শূন্য হয়ে যাবে। সেই ৯০ কর্মদিবস শেষে ১৯৯৫ সালের ৩১ জুলাই সংসদীয় আসনগুলো শূন্য ঘোষণা করা হয়।
এরপর আসনগুলোতে উপনির্বাচনের ঘোষণা আসে। তবে রাজপথে চাপ বাড়ায় বিরোধী দল। টানা হরতাল, অবরোধে বিপর্যস্ত হয়ে পড়ে জনজীবন।
দেশে অচলাবস্থার মধ্যেও বিএনপি সরকার থাকে অনমনীয়। ঘোষণা হয় জাতীয় নির্বাচনের তারিখ। ১৯৯৫ সালের ২৪ নভেম্বর ভেঙে দেয়া হয় পঞ্চম জাতীয় সংসদ।
১৯৯৬ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি ষষ্ঠ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা করা হয়। বিএনপি সরকারের অধীনে সেই নির্বাচনে যেতে অস্বীকার জানায় আওয়ামী লীগ, জাতীয় পার্টি, বামপন্থি দলগুলো, জামায়াতে ইসলামীসহ প্রধান বিরোধী দলগুলো।
১৯৯৪: সংসদ থেকে পদত্যাগপত্র গ্রহণ করেননি বিএনপির স্পিকার
তাদের বর্জন এবং তীব্র আন্দোলনের মধ্যে একতরফা নির্বাচনে এগিয়ে যায় বিএনপি। নতুন নতুন দল গঠন করে ধানের শীষের প্রার্থীদের বিরুদ্ধে প্রতিদ্বন্দ্বিতায় দাঁড় করানো হয়, যে দলগুলোর একটির নাম ছিল ‘জাতীয়তাবাদী আওয়ামী লীগ।’ সেই নির্বাচনের পর অবশ্য এই দলের নাম আর শোনা যায়নি।
সেই নির্বাচনে বহু আসনেই ভোটের আয়োজন করা যায়নি। তবে নির্বাচন কমিশন ৩০০ সংসদীয় আসনের মধ্যে ২৮৯টিতে বিজয়ী ঘোষণা করে বিএনপিকে।
মোট কত শতাংশ ভোট পড়েছিল, সে বিষয়ে সুনির্দিষ্ট কোনো তথ্য নেই। তখন দেশজুড়ে সহিংসতায় অন্তত ১২ জনের মৃত্যুর তথ্য আসে। তবে এখনকার মতো তখন তথ্য জোগাড় করা ছিল কঠিন। ফলে আসল সংখ্যাটি কখনও জানা যায়নি।
সে সময় ১০টি আসন পান স্বতন্ত্র প্রার্থীরা। আর বঙ্গবন্ধুর খুনি সৈয়দ ফারুক রহমানকে কুমিল্লার একটি আসন থেকে বিজয়ী ঘোষণা করা হয়।
অবরোধে অচল দেশে সেই সংসদ সদস্যরা ঢাকায় শপথ নিতে এবং সংসদে যোগ দিতে অ্যাম্বুলেন্সে করেও আসেন বলে সে সময়ের সংবাদপত্রের পাতায় উঠে আসে।
বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া দ্বিতীয় মেয়াদে প্রধানমন্ত্রী টানা নির্বাচিত হলেও তার মেয়াদ হয় দেশের ইতিহাসে সরকারপ্রধান হিসেবে সর্বনিম্ন।
১৯৯৪: সংসদ থেকে পদত্যাগপত্র গ্রহণ করেননি বিএনপির স্পিকার
বিরোধী দলের তীব্র আন্দোলনে ষষ্ঠ সংসদ টেকে কেবল ১২ কর্মদিবস। ১৯৯৬ সালের ১৯ মার্চ বসে সংসদের প্রথম অধিবেশন। দুই দিন পর মার্চ মাসে সংসদে তোলা হয় তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠনের বিল। এ নিয়ে বিরোধী দলের সঙ্গে কোনো আলাপ-আলোচনা অবশ্য হয়নি। নির্ধারণ করা হয়, সবশেষ পদত্যাগী প্রধান বিচারপতির নেতৃত্বে ১০ জন উপদেষ্টা নিয়ে গঠন করা হবে পরিষদ। সেই পরিষদ আয়োজন করবে জাতীয় নির্বাচন।
বিলটি পাস হয় ২৬ মার্চ। পরে প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়ার পরামর্শে সংসদ ভেঙে দেয়া হয় ৩০ মার্চ। প্রধানমন্ত্রীর পদ থেকে পদত্যাগ করেন খালেদা জিয়া।
তৎকালীন সদ্যোবিদায়ী প্রধান বিচারপতি মুহাম্মদ হাবিবুর রহমানকে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান উপদেষ্টা নিয়োগ করা হয়। ওই বছরেই ১২ জুন হয় সপ্তম সংসদ নির্বাচন। সেই নির্বাচনে জিতে ২১ বছর পর ক্ষমতায় ফেরে আওয়ামী লীগ। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে হত্যার পর জাতির পিতার কন্যা শেখ হাসিনার নেতৃত্বে প্রথমবারের মতো ক্ষমতায় আসে আওয়ামী লীগ।
তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান উপদেষ্টা হওয়ার সেই বিধানের কারণেই পরে তৈরি হয় জটিলতা। ২০০১ সালে বিএনপি সরকারে আসার পর বিচারপতিদের অবসরের বয়সসীমা দুই বছর বাড়ানো নিয়ে তৈরি হয় রাজনৈতিক বিরোধ।
সরকারের এই সিদ্ধান্তের ফলে ২০০৬ সালে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান হওয়ার কথা হয় অবসরপ্রাপ্ত প্রধান বিচারপতি কে এম হাসানের। তিনি এককালে বিএনপির আন্তর্জাতিকবিষয়ক সম্পাদক ছিলেন। ফলে তাকে মেনে নিতে রাজি ছিল না আওয়ামী লীগ।
আন্দোলনের একপর্যায়ে কে এম হাসান জানান, তিনি এই পদের জন্য আগ্রহী নন। এরপর তত্ত্বাবধায়ক সরকারপ্রধানের পদে কে আসবেন, এ নিয়ে বিরোধের মীমাংসা না হওয়ার পর বিএনপির নির্বাচিত রাষ্ট্রপতি ইয়াজউদ্দিনের ওপর বর্তায় সেই দায়িত্ব।
ইয়াজউদ্দিনের অধীনে নির্বাচনে না যাওয়ার ঘোষণা দিয়ে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন মহাজোট যায় আন্দোলনে। কিন্তু একবার পিছিয়ে ২০০৭ সালের ২২ জানুয়ারি নির্বাচনের তারিখ ঘোষিত হয়।
একতরফা নির্বাচনের দিকে দেশ যখন এগিয়ে যাচ্ছিল, তখন ভোটের ১১ দিন আগে হস্তক্ষেপ করে সেনাবাহিনী। ইয়াজউদ্দিন আহমেদ জরুরি অবস্থা জারি করে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধানের পদ ছেড়ে দেন। দায়িত্ব নেন ফখরুদ্দীন আহমেদ।
সেই সরকার প্রায় দুই বছর ক্ষমতায় থাকার পর ২০০৮ সালের ২৯ ডিসেম্বর ভোট দেয়। সেই নির্বাচনে নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতায় জিতে ক্ষমতায় আসে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন মহাজোট।
বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের আমলে সংবিধানের যে সংশোধনীর মাধ্যমে এই সরকারব্যবস্থা চালু হয়েছিল, সেই ত্রয়োদশ সংশোধনীর বৈধতা চ্যালেঞ্জ করে আইনজীবী এম সলিম উল্লাহসহ কয়েকজন রিট আবেদন করেন। শুনানি নিয়ে ২০০৪ সালে হাইকোর্ট তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থাকে বৈধ বলে ঘোষণা করে।
ওই রায়ের বিরুদ্ধে আপিল বিভাগে যায় রিট আবেদনকারী পক্ষ। ২০১০ সালের ১১ মে আপিল বিভাগ হাইকোর্টের রায় পাল্টে এই সরকারব্যবস্থাকে অবৈধ ঘোষণা করে। আপিল বিভাগের সেই আদেশের ওপর ভিত্তি করে ওই বছরের ২৪ জুন সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনী পাস হয়। এতে তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা বিলোপের পাশাপাশি দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচনের ব্যবস্থা হয়।
এরপর ২০১৪ সালের দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচন বর্জন করা বিএনপি ২০১৮ সালের একাদশ সংসদ নির্বাচনে অংশ নিলেও এবার ৯০ দশকের স্মৃতি ফের ফিরিয়ে আনছে। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবিতে আন্দোলনে নেমেছে তারা।
আরো সংবাদ পড়ুন