‘অনড়’ বিএনপিকে নমনীয় হতে বলেছে তৃণমূল
স্থানীয় সরকার নির্বাচনে
নিউজ ডেস্ক আদালত বার্তা : ১১ মার্চ ২০২৪
ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে সব ধরনের নির্বাচন বর্জন করেছে বিএনপি। তবে আসন্ন উপজেলা নির্বাচন নিয়ে দলের সম্ভাব্য প্রার্থীদের তৎপরতা ভাবাচ্ছে বিএনপির হাইকমান্ডকে। শনিবার কুমিল্লা, ময়মনসিংহ সিটি করপোরেশনসহ একাধিক উপজেলা ও পৌরসভায় উপনির্বাচন হয়েছে। কুমিল্লায় বিএনপির বহিষ্কৃত দুই নেতা প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেও বিজয়ী হতে পারেননি। তবে ময়মনসিংহের ত্রিশালে বর্তমান সংসদ সদস্য এবিএম আনিসুজ্জামানের স্ত্রী শামীমা আক্তারকে হারিয়ে পৌরসভার মেয়র পদে উপনির্বাচনে বিজয়ী হয়েছেন উপজেলা যুবদলের সাবেক যুগ্ম আহ্বায়ক আমিনুল ইসলাম। যদিও আমিনুল ইসলাম বর্তমানে বিএনপির কেউ নন, তবে তাকে মানুষজন বিএনপি নেতা হিসেবেই চেনেন। তার বিজয়ে অনুপ্রাণিত হয়ে অন্যান্য স্থানেও নির্বাচনে অংশ নিতে পারেন তৃণমূলের নেতারা। এজন্য তারা নির্বাচনে অংশ নেওয়ার ব্যাপারে দলের হাইকমান্ডকে নমনীয় হতে বলেছেন।
তবে বিএনপির নীতিনির্ধারকরা বলছেন, এটি সরকারের কৌশল হতে পারে। কারণ বিএনপি যখন নির্বাচনে না যাওয়ার ঘোষণা দিয়েছে, তখন তৃণমূলের নেতাকর্মীদের মনোবল ভাঙতে সরকারি দল এ ধরনের কৌশল নিতে পারে। বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী বলেছেন, নির্বাচনে অংশ না নেওয়াটা দলীয় সিদ্ধান্ত। কাউকে নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে দেওয়া হচ্ছে না। যখন সরকারের বৈধতা প্রশ্নবিদ্ধ, তখন আমরা কীভাবে নির্বাচনে অংশ নিতে পারি। তাই কাউকে নির্বাচন করতে দেওয়া হচ্ছে না।
নির্বাচন কমিশন জানিয়েছে, চার ধাপে উপজেলা পরিষদ নির্বাচনের প্রথম ধাপের ভোট গ্রহণ হবে ৪ মে, দ্বিতীয় ধাপ ১১ মে, তৃতীয় ধাপে ১৮ মে এবং চতুর্থ ও শেষ ধাপের ভোট হবে ২৫ মে। কোন উপজেলা কোন ধাপে পড়বে সেটা ইসির ওয়েবসাইটে জানানো হবে। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, আগামী ৪ মে থেকে দেশব্যাপী প্রথম ধাপের উপজেলা নির্বাচন শুরু হতে যাচ্ছে। এই নির্বাচনে অংশগ্রহণ না করার ঘোষণা দিয়েছে জাতীয় সংসদসহ সব ধরনের নির্বাচন বর্জন করা বিএনপি। তবে দলটির মাঠপর্যায়ের অনেক নেতা এবারও দলের সিদ্ধান্ত উপেক্ষা করে নির্বাচনী মাঠে থাকছেন। সম্ভাব্য প্রতিদ্বন্দ্বী এসব নেতারা বলছেন, তারা একরকম ‘জিম্মি’ দশায় রয়েছেন। তারা এখন নিরুপায় হয়ে নির্বাচনের মাঠে থাকতে চান। উপজেলা নির্বাচনে অংশ নেওয়ার বিষয়ে মূলত সাবেক ও বর্তমান জনপ্রতিনিধিরাই বেশি আগ্রহী। প্রথম ধাপের নির্বাচন অন্তত ১০ জন বিএনপির সাবেক ও বর্তমান নেতা এই নির্বাচনে মাঠে থাকছেন বলে জানা গেছে। এসব সম্ভাব্য প্রার্থী জানিয়েছেন, প্রতীক না থাকাটাই নির্বাচনে অংশ নিতে দলের তৃণমূল নেতাকর্মীদের প্রলুব্ধ করেছে। দলীয় প্রতীক না থাকায় ব্যক্তিগত জনপ্রিয়তার জোরে স্থানীয় সরকারে জনপ্রতিনিধি হওয়ার সুযোগ তাদের সামনে রয়েছে। সারা দেশে প্রথম ধাপের উপজেলা নির্বাচনে ৫০ জনের মতো বিএনপির সাবেক ও বর্তমান নেতা অংশ নিতে পারেন। তাদের মধ্যে অন্তত ১০ জন নেতার প্রচার চালানোর খবর পাওয়া গেছে।
যদিও বিএনপির পক্ষ থেকে হুঁশিয়ারি দিয়ে বলা হয়েছে, দলীয় সিদ্ধান্ত উপেক্ষা করে যারাই স্থানীয় সরকার নির্বাচনে অংশগ্রহণ করবেন, তাদের অতীতের মতোই দল থেকে বহিষ্কার করা হবে। বিএনপির শীর্ষ নেতাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, উপজেলা নির্বাচনে যাওয়া-না যাওয়া নিয়ে বিএনপিতে দুই ধরনের মত রয়েছে। রাজনৈতিক কৌশলের অংশ হিসেবে নির্বাচনে যাওয়ার পক্ষে একটি অংশ। আরেক পক্ষ মনে করে, এই নির্বাচনে গেলে তেমন কোনো অর্জন হবে না, বরং নৈতিকতা নিয়ে প্রশ্নবিদ্ধ হতে হবে। এ অবস্থায় স্থানীয় পর্যায়ের এই নির্বাচনে অংশ না নেওয়ার সিদ্ধান্তের কথা জানিয়েছে বিএনপি।
বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী সম্প্রতি গণমাধ্যমকে বলেছেন, দলীয় সিদ্ধান্ত উপেক্ষা করে উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে অংশ নিলে অতীতের মতোই দল থেকে বহিষ্কার করা হবে।
জানা যায়, রাজনৈতিক বাস্তবতা বিবেচনায় সংগঠনকে আরও শক্তিশালী ও নেতাকর্মীদের চাঙ্গা রাখতে উপজেলা নির্বাচনে অংশ নিতে আগ্রহী বিএনপির তৃণমূলের বিরাট একটি অংশ। দলের হাইকমান্ডকে এ বিষয়ে তাগাদাও দেওয়া হচ্ছে। তাদের মতে, বিএনপিন দলীয়ভাবে নির্বাচনে না গেলেও স্থানীয় সরকার নির্বাচনে তৃণমূলের অনেক নেতা কিন্তু প্রতিদ্বন্দ্বিতা করবেন। নানা কারণেও তাদের নির্বাচন করতে হয়। বিশেষ করে পারিবারিক ও আত্মীয়তার সম্পর্ক ধরে রাখা, বংশগত ঐতিহ্য বজায় রাখা এবং স্থানীয় নেতাকর্মীদের চাপ। দল নির্বাচনে না গেলেও স্থানীয় নেতাকর্মীদের ধরে রাখা দুষ্কর। স্থানীয় রাজনীতিতে টিকে থাকতে কখনো কখনো দলের উচিত সিদ্ধান্ত বদলানো। সেই লক্ষ্যেই আসন্ন উপজেলা নির্বাচনে বিএনপির হাইকমান্ডের উচিত হবে কেউ প্রার্থী হলে তার ব্যাপারে নমনীয় হওয়া। ঘোষণা দিয়ে নির্বাচনে অংশ না নিলেও কেউ প্রার্থী হলে তার বিরুদ্ধে সাংগঠনিক ব্যবস্থা যেন না নেওয়া হয়।
অতীতে বিএনপির ধানের শীষ প্রতীকে জনপ্রতিনিধি নির্বাচিত হয়েছিলেন এমন কয়েকজন জানান, স্থানীয় সরকার নির্বাচনে অংশ নিলে সামাজিক বন্ধন এবং সংগঠন আরও সুদৃঢ় হয়। নেতাকর্মীদের মধ্যে উদ্দীপনাও দেখা দেয়। তা ছাড়া দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ডামি প্রার্থী দেওয়ার কারণে আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের মাঝে যে বিভক্তি ও দ্বন্দ্ব তৈরি হয়েছে, তাতে বিএনপির প্রার্থীরা সুবিধা করতে পারবেন। অবশ্য এ বিষয়ে দলটির নীতিনির্ধারকরা নতুনভাবে কোনো সিদ্ধান্ত নেয়নি। এক্ষেত্রে কেউ স্বতন্ত্রভাবে নির্বাচনে গেলে দল কোনো পদক্ষেপ নাও নিতে পারে বলে সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে।
বিএনপির যুগ্ম মহাসচিব সৈয়দ মোয়াজ্জেম হোসেন আলাল বলেন, এ কথা সত্য যে, বর্তমান সরকারের আমলে নির্বাচন কোনোভাবেই সুষ্ঠু হয়নি এবং হবেও না। বিএনপির যদি নীতিগত সিদ্ধান্ত থাকে দলীয়ভাবে নির্বাচনে যাবে না; সেটা ঠিক। এ পর্যন্ত থাকলেই ভালো। তবে তৃণমূলের কোনো নেতা যদি স্থানীয় নেতাকর্মীদের নিয়ে চড়াই-উতরাই পেরিয়ে নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে জয়ী হয়ে টিকে থাকেন, তাহলে অসুবিধা কোথায়? কারও বিরুদ্ধে পরবর্তী পদক্ষেপ না নেওয়াই শ্রেয়।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, ২০১৪ সালের পর ফেব্রুয়ারিতে অনুষ্ঠিত উপজেলা নির্বাচনে বিএনপির স্থানীয় নেতারা অংশগ্রহণ করেছিলেন। ২০১৮ সালের পর স্থানীয় সরকারের নির্বাচনে প্রথমদিকে অংশ নিলেও ২০২১ সালের ২৭ ফেব্রুয়ারি বিএনপির স্থায়ী কমিটির বৈঠকে স্থানীয় সরকার নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা না করার সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। একই সঙ্গে স্থানীয় সরকারের বিভিন্ন উপজেলা পরিষদে উপনির্বাচন ও সব পৌরসভা নির্বাচনে সরকারের ‘নগ্ন হস্তক্ষেপ’ এবং নির্বাচন ‘সুষ্ঠু’ করতে নির্বাচন কমিশন চরম ব্যর্থতা দেখিয়েছে মর্মে বিএনপির স্থায়ী কমিটির বৈঠকে নিন্দা ও ধিক্কারও জানানো হয়েছে। ওই বছরের ২৮ ফেব্রুয়ারি গুলশানে বিএনপির চেয়ারপারসনের রাজনৈতিক কার্যালয়ে দলের মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর সংবাদ সম্মেলনে বলেছিলেন, ‘আগামীতে স্থানীয় সরকার নির্বাচনে আমরা আর কাউকে মনোনয়ন দেব না।’ তারই ধারাবাহিকতায় সব স্থানীয় নির্বাচন বর্জন করে বিএনপি। এর পরও দলীয় সিদ্ধান্ত অমান্য করে প্রার্থী হওয়ায় কুমিল্লায় মনিরুল হক সাক্কু, নারায়ণগঞ্জে তৈমুর আলম অখন্দকারসহনেককে দলীয় পদ-পদবি থেকে বহিষ্কার করেছে বিএনপি।