ড. সৈয়দ হুমায়ুন আখতার,সম্প্রতি ভূমিকম্প অনুভব নিয়ে যা বলেন------
নিউজ ডেস্ক আদালত বার্তাঃ২২ নভেম্বর ২০২৫
ড. সৈয়দ হুমায়ুন আখতার, ভূমিকম্প বিশেষজ্ঞ ও বাংলাদেশ উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য।সম্প্রতি ভূমিকম্প অনুভব নিয়ে যা বলেন------
বাংলাদেশে গতকাল শুক্রবার সকালে যে প্রচণ্ড ঝাঁকুনি অনুভূত হয়েছে, দেশের পটভূমিতে সাম্প্রতিক সময়ে তা সর্বোচ্চ। বাংলাদেশের উত্তরে আছে ইন্ডিয়ান প্লেট এবং ইউরেশিয়ান প্লেটের সংযোগস্থল; পূর্বে বার্মিজ প্লেট ও ইন্ডিয়ান প্লেটের সংযোগস্থল। প্লেটগুলো গতিশীল থাকায় বাংলাদেশ ভূখণ্ড ধীরে ধীরে সরে যাচ্ছে।
শক্তি লকড অবস্থায় ছিল, আটকে ছিল। এটা আনলকিং শুরু হয়েছে। এখন পরবর্তী সময়ে গ্যাপ দিয়ে আবার ভূমিকম্প হতে পারে।
ঢাকার এত কাছে গত কয়েক দশকে বড় ভূমিকম্প হয়নি। কয়েক জেনারেশন এ রকম ভূমিকম্প দেখেনি। দেশে সাম্প্রতিক সময়ে হালকা ও মাঝারি মাত্রার বেশ কয়েকটি ভূমিকম্প হলেও সেগুলোর কোনোটিই মাত্রার দিক দিয়ে শক্তিশালী বা প্রলয়ঙ্করী ছিল না। তবে গত ৩০০ বছরে সেরকম কয়েকটি ভূমিকম্প ঘটেছে, সেগুলোর উৎপত্তিস্থল দেশের ভেতরে বা আশপাশের এলাকায় ছিল। টেকনাফ থেকে মিয়ানমার পর্যন্ত প্রায় ৪০০ কিলোমিটার বিস্তৃত ফল্ট লাইনে ১৭৬২ সালে ৮ দশমিক ৫ মাত্রার শক্তিশালী ভূমিকম্প হয়। ওই ভূমিকম্পেই সেন্টমার্টিন দ্বীপ প্রায় তিন মিটার ওপরে উঠে আসে; আগে সেটি ছিল ডুবন্ত দ্বীপ। সেবার সীতাকুণ্ডে পাহাড়ের নিচ থেকে কাদা-বা
লুর উদ্গিরণ ঘটে, বঙ্গোপসাগরে বিশাল আকারের ঢেউ তৈরি হয়ে বহু ঘরবাড়ি ভেসে যায়, প্রায় ২০০ মানুষের প্রাণহানি ঘটে। সেই ভূমিকম্প ব্রহ্মপুত্র নদের গতিপথ বদলে দেয়। রিখটার স্কেলে ৭ দশমিক ৫ মাত্রার এ ভূমিকম্প ‘কাচার আর্থকোয়াক’ নামে পরিচিতি পায়। এর উৎপত্তিস্থল ছিল সিলেটের খুব কাছে জৈন্তা পাহাড়ের উত্তরাংশে অবস্থিত শিলচড়ে। সেই ভূমিকম্পে শিলচড়, নওগাং ও ইম্ফল এলাকায় বহু স্থাপনা ধসে পড়ে। তবে প্রাণহানির সঠিক সংখ্যা জানা যায়নি। ১৮৮৫ সালের ১৪ জুলাই এ ভূমিকম্পের মাত্রা ছিল রিখটার স্কেলে ৭, উৎপত্তিস্থল ছিল মানিকগঞ্জের সাটুরিয়ায়। ভারতের সিকিম, বিহার, মণিপুর ও মিয়ানমার পর্যন্ত এর কম্পন অনুভূত হয়।
ঢাকা, বগুড়া, ময়মনসিংহ, শেরপুর এবং পাবনায় প্রাণহানি ঘটে। ‘গ্রেট ইন্ডিয়ান আর্থকোয়েক’ নামে পরিচিত এ ভূমিকম্পের মাত্রা ছিল ৮ দশমিক ৭। উৎপত্তিস্থল ছিল মেঘালয়ের শিলং অঞ্চল। সেই ভূমিকম্পে দেড় হাজারের বেশি মানুষের মৃত্যু হয়, সিলেটেই প্রাণহানির সংখ্যা ছিল পাঁচ শতাধিক। সিলেটের বহু বাড়িঘর বিধ্বস্ত হয়, ময়মনসিংহ এবং দেশের উত্তরাঞ্চলেও ব্যাপক ক্ষতি হয়। সেইবার বিভিন্ন এলাকায় ফাটল দেখা দেয় এবং সুরমা ও ব্রহ্মপুত্র নদের গতিপথে প্রভাব পড়ে।
১৯১৮ সালে ভয়াবহ ভূমিকম্প হয়। এর মাত্রা ছিল রিখটার স্কেলে ৭ দশমিক ৬। উৎপত্তিস্থল ছিল শ্রীমঙ্গলের বালিছড়া। সেই সময় শ্রীমঙ্গল ও ভারতের ত্রিপুরা অঞ্চলে বড় ধরনের ক্ষয়ক্ষতি হয়। তবে প্রাণহানির সংখ্যা নিশ্চিত হওয়া যায়নি। চট্টগ্রামে ৬ দশমিক ১ মাত্রার আরেকটি ভূমিকম্পে ২৩ জনের মৃত্যু হয়, তবে ক্ষয়ক্ষতি খুব বেশি হয়নি। মহেশখালীতে পরবর্তী সময়ে ৫ দশমিক ২ মাত্রা ভূমিকম্প হয়। তখন অন্তত ছয়জনের মৃত্যু হয়।
ঘন ঘন কম মাত্রার যে ভূমিকম্পগুলো হচ্ছে, সেগুলো ৮ দশমিক ২ থেকে ৯ মাত্রার ভূমিকম্প তৈরি হওয়ার মতো যে শক্তি ভূতকের মধ্যে জমা হয়ে আছে, এই শক্তিটা বের হওয়ার ইঙ্গিত দিচ্ছে।
বাংলাদেশ কম ভূমিকম্পপ্রবণ দেশ হলেও ঝুঁকির দিক দিয়ে খুব ওপরে রয়েছে। যে পরিমাণ শক্তি ইন্ডিয়ান-বার্মা প্লেটের সংযোগস্থলে জমা হয়ে আছে, সেই শক্তিটা যদি বের হয়, তাহলে বড় মাত্রার ভূমিকম্প হতে পারে। এটি আগামীকালও হতে পারে, আগামী ৫০ বছর পরেও হতে পারে। কখন হবে, সেটি আমরা বলতে পারি না। তবে যেটি হবে, সেটি খুব ব্যাপক হবে। সাবডাকশন জোনের ভূমিকম্পগুলো ভয়ংকর হয়। এখন একমাত্র উপায় হচ্ছে মহড়া। ভূমিকম্পের সময় কয়েক কদমের মধ্যে নিরাপদ জায়গায় চলে যাওয়ার প্রশিক্ষণ নিতে হবে। দেশের যে অবকাঠামো তা তো পরিবর্তন করা যাবে না। একমাত্র উপায় মহড়া।