মহামান্য হাইকোর্ট বিভাগে 𝑾𝒓𝒊𝒕 (রিট)করার বিধান (সংবিধানের আলোকে)।
এডভোকেট মোহাম্মদ এনামুল হক আদালত বার্তাঃ ১৯ফেব্রুয়ারি ২০২৪।
মহামান্য হাইকোর্ট বিভাগে 𝑾𝒓𝒊𝒕 (রিট)করার বিধান নিয়ে কিছু আলোচনা। (সংবিধানের আলোকে)
-------------------------------------------------------------------
১। কোন নাগরিকের মৌলিক অধিকার লঙ্ঘনের কিংবা প্রচলিত আইনে প্রতিকার নেই এমন ক্ষেত্রে বাংলাদেশ সংবিধানের ১০২ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী হাইকোর্ট বিভাগে যে পিটিশন দায়ের করা হয় তাকে রিট বলা হয়। হাইকোর্ট ডিভিশনের স্পেশাল অরিজিনাল এখতিয়ার হচ্ছে রিট। এই বিষয়ে হাইকোর্ট ডিভিশন অবারিত ক্ষমতা ব্যবহার করতে পারে অর্থাৎ বিষয় বিবেচনা করে যেকোনো আদেশ দিতে পারে কোনো কিছুই আদালতকে বারিত করে না । এক্ষেত্রে সীমাবদ্ধতা হলো বেসরকারি কোনো সংস্থায় কর্মরত কর্মকর্তা বা কর্মচারীর বিরুদ্ধে রিট করা যায় না অর্থাৎ প্রাইভেট সংস্থা যদি মৌলিক অধিকার ক্ষুণ্ন করে তাহলে তা হবে অপরাধ, তখন রিট মামলা করা যাবে না। মামলা করতে হবে দেওয়ানী আদালতে।
২। সংবিধানে মৌলিক অধিকার কোনগুলো?
-----------------------------------------------------------------
সমাজে মর্যাদাপূর্ণভাবে বেঁচে থাকতে একজন মানুষের যেসব অধিকার দরকার, সেগুলো মানবাধিকার হিসেবে বিবেচিত হয়। একটি রাষ্ট্রের আর্থসামাজিক প্রেক্ষাপটে এসবের মধ্য থেকে কিছু অধিকারকে মৌলিক হিসেবে ঘোষণা করে সংবিধানে অন্তর্ভুক্ত করা হয়। এই মৌলিক অধিকার ভঙ্গ হলে রাষ্ট্র প্রতিকার দিতে বাধ্য থাকে। সংক্ষেপে বলতে গেলে,মানবাধিকার মানুষের জন্মগত। আর মৌলিক অধিকার হলো আইনিভাবে স্বীকৃত।
৩। বাংলাদেশের সংবিধানে মৌলিক অধিকার প্রতিটি দেশের সংবিধানেই মৌলিক অধিকারের বিষয়টি সুস্পষ্টভাবে উল্লেখ আছে। বাংলাদেশ সংবিধানের তৃতীয় ভাগে মৌলিক অধিকার নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করা হয়েছে। সংবিধানের ২৬ থেকে ৪৭ (ক) অনুচ্ছেদগুলো মৌলিক অধিকার সংশ্লিষ্ট। তৃতীয় ভাগের শুরুতে অর্থাৎ ২৬ নম্বর অনুচ্ছেদেই বলা হয়েছে, মৌলিক অধিকারের সঙ্গে অসামঞ্জস্যপূর্ণ কোনো আইন করা যাবে না। আর যদি করা হয় তবে তা বাতিল হয়ে যাবে। সরকার বা মন্ত্রিপরিষদ ইচ্ছা করলেই মৌলিক অধিকার পরিপন্থী আইন তৈরি করে এর ব্যত্যয় ঘটাতে পারবে না।
ক) আইনের দৃষ্টিতে সমতা
-----------------------------------
সংবিধানের ২৭ নম্বর অনুচ্ছেদে বিদ্যমান আইনে নাগরিকদের কীভাবে দেখা হয়, সে বিষয়ে বলা হয়েছে। এই অনুচ্ছেদে বলা আছে, আইনের দৃষ্টিতে প্রতিটি নাগরিক সমান।
খ) অবস্থানগত কারণে বৈষম্য
---------------------------------------
ধর্ম, বর্ণ, লিঙ্গ, বাসস্থান বা পেশাগত কারণে কোনো নাগরিকের প্রতি বৈষম্য করা যাবে না। মৌলিক এ অধিকারের বিষয়ে সংবিধানের ২৮ নম্বর অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে।
গ) সরকারি চাকরিতে অধিকার
------------------------------------------
২৯ নম্বর অনুচ্ছেদে সরকারি চাকরিতে সবার সমান সুযোগ আছে বলে উল্লেখ করা হয়েছে।
ঘ) আইনের আশ্রয়লাভের অধিকার
-----------------------------------------------
রাষ্ট্রের যেকোনো নাগরিকের আইনের আশ্রয়লাভের অধিকার আছে উল্লেখ করে সংবিধানের ৩১ ও ৩২ নম্বর অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, সুস্পষ্ট কারণ ছাড়া কোনো নাগরিকের বিরুদ্ধে এমন কোনো ব্যবস্থা নেওয়া যাবে না যাতে তাঁর জীবন, স্বাধীনতা, দেহ, সুনাম বা সম্পদের ক্ষতি হয়।
ঙ) বিনা বিচারে আটক
------------------------------
কোনো ব্যক্তিকে আটক করা নিয়ে নির্দেশনা আছে ৩৩ নম্বর অনুচ্ছেদে। এতে বলা হয়েছে, বিনা কারণে কাউকে আটক করা যাবে না। কোনো কারণে কাউকে আটক করা হলে, সেটির কারণ জানিয়ে যথাযথ আইনি ব্যবস্থা গ্রহণের সুযোগ দিতে হবে। কোনো অবস্থায় তাকে ২৪ ঘণ্টার বেশি সময় হাজতে রাখা যাবে না। আটকের ২৪ ঘণ্টার মধ্যে পার্শ্ববর্তী ম্যাজিস্ট্রেটের কাছে আটক ব্যক্তিকে হাজির করে যথাযথ ব্যবস্থা নিতে হবে।
চ) জোরপূর্বক শ্রম
------------------------
ফৌজদারি অপরাধের সাজাপ্রাপ্ত আসামি না হলে অথবা জনগণের বৃহৎ স্বার্থে আবশ্যক না হলে কাউকে জোর করে কোনো কাজ করানো যাবে না। এ বিষয়টি বলা হয়েছে ৩৪ নম্বর অনুচ্ছেদে।
ছ) বিচার ও দণ্ড সম্পর্কে রক্ষণ
----------------------------------------
কেউ কোনো অপরাধ করলে তার বিচার অবশ্যই ওই সময়ে প্রচলিত আইনে করতে হবে বলে ৩৫ নম্বর অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে। এক অপরাধের জন্য একাধিকবার শাস্তি দেওয়া যাবে না। এ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী, প্রতিটি নাগরিকের স্বাধীন ও নিরপেক্ষ বিচারের অধিকার রয়েছে। কাউকে নিজের বিরুদ্ধে সাক্ষ্য দিতে বাধ্য করা যাবে না এবং নিষ্ঠুর, অমানুষিক বা লাঞ্ছনাকর দণ্ড দেওয়া যাবে না।
জ) সমাবেশ, সংঘটন ও চলাফেরার স্বাধীনতা
------------------------------------------------------------
জনস্বার্থে আইনের মাধ্যমে আরোপিত যুক্তিসংগত বাধানিষেধ ছাড়া দেশের যেকোনো স্থানে অবাধ চলাফেরার, দেশত্যাগ ও পুনঃপ্রবেশের স্বাধীনতা রয়েছে নাগরিকদের। ৩৬, ৩৭ ও ৩৮ নম্বর অনুচ্ছেদে বিষয়গুলোর উল্লেখ করা হয়েছে। এ অনুচ্ছেদগুলোতে জনস্বাস্থ্য ও জনশৃঙ্খলার প্রতি গুরুত্ব দিয়ে যেকোনো সমাবেশ বা সংগঠনের অধিকার প্রতিটি নাগরিকেরই রয়েছে বলে জানানো হয়েছে।
ঞ) পেশা নির্বাচনের স্বাধীনতা
---------------------------------------
যেকোনো নাগরিক আইন অনুযায়ী যেকোনো কাজকে নিজের পেশা হিসেবে বাছাই করতে পারবে বলে ৪০ নম্বর অনুচ্ছেদে উল্লেখ করা হয়েছে।
ট) ধর্মীয় স্বাধীনতা
------------------------
প্রতিটি নাগরিকের নিজ নিজ ধর্ম পালনের স্বাধীনতা থাকবে বলে ৪১ নম্বর অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে। এতে বলা হয়, কাউকে জবরদস্তি করে কোনো ধর্ম পালনে বা পাঠদানে বাধ্য করা যাবে না।
ঠ) সম্পত্তির অধিকার
-----------------------------
আইনের মাধ্যমে আরোপিত বাধা-নিষেধ সাপেক্ষে প্রতিটি নাগরিক সম্পত্তি অর্জন, ধারণ, হস্তান্তর করতে পারবে বলে ৪২ নম্বর অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে।
ড) গৃহ ও যোগাযোগের অধিকার
-------------------------------------------
রাষ্ট্রের নিরাপত্তা, জনশৃঙ্খলার স্বার্থে আইনের মাধ্যমে আরোপিত বাধা-নিষেধ সাপেক্ষে প্রতিটি নাগরিকের নিজ গৃহে নিরাপত্তা লাভের অধিকার থাকবে। ৪৩ নম্বর অনুচ্ছেদে বিষয়টির উল্লেখ করে বলা হয়েছে, নাগরিকদের চিঠিপত্র ও যোগাযোগের গোপনীয়তা রক্ষা করা রাষ্ট্রের দায়িত্ব।
***মৌলিক অধিকার ভঙ্গ হলে করণীয় ।
----------------------------------------------------
যে কোনো কারণে মৌলিক অধিকার ভঙ্গ হতে পারে। এ ক্ষেত্রে সংক্ষুব্ধ ব্যক্তি সংবিধানের ১০২(১) নম্বর অনুচ্ছেদ অনুযায়ী সুপ্রিম কোর্টের হাইকোর্ট বিভাগে রিট আবেদনের মাধ্যমে অধিকার পুনরুদ্ধার করতে পারবেন।
৪। সরকারী চাকুরী থেকে অপসারিত একজন সরকারী কর্মচারী তার অপসারণের বিরুদ্ধে রিট দায়ের করতে পারেন কিনা?
-------------------------------------------------------------
নিয়ম অনুযায়ী সরকারী চাকুরী সংক্রান্ত বিষয়গুলো প্রশাসনিক ট্রাইব্যুনাল নিষ্পত্তি করে থাকেন। চাকুরী থেকে অপসারিত একজন সরকারী কর্মচারী ইচ্ছা করলে তার অপসারণের বিরুদ্ধে উৎপ্রেষণ রিট (Writ of Certiorari) দায়ের করতে পারেন। এই রিটের মূল কথা হলো, কোন অধস্তন আদালত, ট্রাইব্যুনাল, কর্তৃপক্ষ, সংস্থা বা ব্যক্তি তার আইনগত ক্ষমতাকে লঙ্ঘন করে কিংবা স্বাভাবিক ন্যায়-নীতি ভঙ্গ করে তবে হাইকোর্ট বিভাগে সংক্ষুব্ধ ব্যক্তি আবেদন করতে পারেন। এই ধরনের আবেদনের উপর ভিত্তি করে হাইকোর্ট বিভাগ অপসারণ আদেশ বৈধ কিনা তা যাচাই করে দেখতে পারেন। সরকারী কর্মকর্তাকে যদি অন্যায়ভাবে অপসারণ করা হয়ে থাকে তাহলে উক্ত অপসারণ আদেশকে হাইকোর্ট বিভাগ অবৈধ ঘোষণা করতে পারেন।
৫। হাইকোর্ট বিভাগের স্ব-উদ্যোগে [suo motu] রিট জারির এখতিয়ার ।
-----------------------------------------------------------------
কোন পত্র বা তথ্যে বা সংবাদপত্রে প্রকাশিত সংবাদের উপর ভিত্তি করে হাইকোর্ট বিভাগের স্ব-উদ্যোগে [suo motu] রিট জারি করার এখতিয়ার সংবিধানের ১০২ অনুচ্ছেদে বলা নেই। তবে বাংলাদেশ সুপ্রীম কোর্টের হাইকোর্ট বিভাগ The Supreme Court of Bangladesh (High Court Division) Rules,1973 এর ১০ বিধি অনুযায়ী কোন পত্র বা তথ্যে বা সংবাদপত্রে প্রকাশিত সংবাদের উপর ভিত্তি করে স্ব-উদ্যোগে [suo motu] রিট জারি করতে পারে। এটাকে হাইকোর্ট বিভাগের Epistolary Jurisdiction বলা হয়। তবে এক্ষেত্রে অবশ্যই জনগণের মারাত্মক ক্ষতি হতে যাচ্ছে বলে আদালতের নিকট প্রতীয়মান হতে হবে। Tayeeb vs Bangladesh (২০১৫) মামলায় আপীল বিভাগ মতামত দেন, কারো মৌলিক অধিকার লংঘন হলে হাইকোর্ট বিভাগ স্ব-উদ্যোগে [Suo motu] রিট জারী করতে পারে। তবে এক্ষেত্রে great public importance থাকতে হবে। সংবাদপত্রের রিপোর্ট, কোন তথ্যকে হাইকোর্ট বিভাগ কর্তৃক এক্ষেত্রে রিট এপ্লিকেশন হিসেবে বিবেচনা করা হবে।