আধাসামরিক ইপিআর-এর ওয়্যারলেস এবং বাংলাদেশের স্বাধীনতা।
ডেস্ক নিউজ, আদালত বার্তা:২৭ মার্চ ২০২৩।
৭ মার্চের ভাষণের প্রতিক্রিয়া এভাবে ধাপে ধাপে ২৫ মার্চ পর্যন্ত পেীছে। ২৫ মার্চ রাতে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান যখন বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘােষণা করলেন, কখন দেশবাসীর কাছে তার সেই বাণী পৌছে দিতে সহায়ক হয়ে উঠল আধাসামরিক বাহিনীর একটি ওয়্যারলেস সেট। পাকিস্তানি সৈন্যরা ২৫ মার্চ রাতে কামান, মর্টার ও রাইফেল ইত্যাদি নিয়ে অতর্কিতে বাঙালির ওপর যখন ঝাঁপিয়ে পড়ে, বঙ্গবন্ধু তখন গ্রেফতার হওয়ার ঠিক পূর্বমুহূর্তে তার সর্বশেষ বাণী বাংলার মানুষের কাছে পাঠান এই মর্মে :
This may be my last message. From today Bangladesh is independent. I call upon the people to Bangladesh wherever you might be and with whatever you have, to resist army of occupation to the last. Your fight must go on until the last soldier of the Pakistan occupation army is expelled from the soil of Bangladesh and final victory is achieved.
[স্বাধীনতার দলিল, ৩য় খণ্ড]
[এই-ই হয়তাে তােমাদের জন্য আমার শেষ বাণী। আজকে থেকে বাংলাদেশ একটি স্বাধীন দেশ। যে যেখানেই থেকে থাকো, যে অবস্থায় থাকো, হাতে যার যা আছে, তা-ই দিয়ে দখলদার সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে শেষ নিঃশ্বাস পর্যন্ত প্রতিরােধ গড়ে তােলাে। ততদিন পর্যন্ত লড়াই চালিয়ে যাবে, যতদিন পর্যন্ত না দখলদার পাকিস্তানিদের শেষ সৈনিকটি বাংলাদেশের মাটি থেকে বহিস্কৃত হচ্ছে এবং চূড়ান্ত বিজয় অর্জিত হচ্ছে ।]
এ প্রসঙ্গে জেনারেল টিক্কা খানের জনসংযােগ অফিসার সিদ্দিক সালিক সাক্ষ্য দিয়েছেন :
পাকিস্তান রেডিওর সরকারি তরঙ্গের (ওয়েভ লেংথ-এর) কাছাকাছি একটি তরঙ্গ থেকেও ২৫ মার্চ রাতে শেখ মুজিবের এই ঘােষণা ক্ষীণ কণ্ঠে ভেসে উঠেছিল। [সিদ্দিক সালিক, নিয়াজীর আত্মসমর্পণের দলিল (ভাষান্তর : মাসুদুল হক), ঢাকা : নভেল পাবলিকেশন্স, ১৯৮৮, পৃষ্ঠা ৮৫]। সিদ্দিক সালিক ১৯৭১ সালে ঢাকায় হানাদার পাকিস্তানিদের গণসংযােগ অফিসারের দায়িত্ব পালন করেছিলেন- লেখক।
বাংলার অবিসংবাদিত নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব যখন ইপিআর ওয়্যারলেসযােগে স্বাধীনতার ঘােষণা প্রচার করছিলেন, তখন সবে পাকবাহিনী ক্যান্টনমেন্ট থেকে বের হচ্ছে। এরা ফার্মগেট এসে পৌছামাত্র প্রতিরােধের সম্মুখীন হয়। তারপর তারা পিলখানায় ইপিআর ও রাজারবাগে পুলিশের দুর্গ দুটিতে আক্রমণ চালায়। বঙ্গবন্ধু গ্রেফতার হওয়ার পূর্বমুহূর্তে এ খবর পেয়েছিলেন। ফলে তিনি আরেকটি বার্তা ঢাকার টিঅ্যান্ডটি মারফত পাঠান। ঢাকার টিঅ্যান্ডটির (টেলিগ্রাফ ও টেলিফোন) এক্সচেঞ্জ তখনাে খােলা ছিল। সর্বশেষ যে বার্তাটি তিনি পাঠান, তাতে বলা হয় ।
পাকিস্তানি সৈন্যবাহিনী পিলখানায় পূর্ব পাকিস্তান রাইফেলসের সদর দপ্তর আর রাজারবাগ পুলিশ লাইনের ওপর আক্রমণ করেছে। সমস্ত শক্তি জড়াে করে প্রতিরােধ করুন আর স্বাধীনতার জন্যে প্রস্তুতি নিন। [রবার্ট পেইন : ম্যাসাকার (বাংলাদেশ- গণহত্যার ইতিহাসে ভয়ংকর অধ্যায়, ভাষান্তর : গােলাম হিলালী), ঢাকা : ইউনিভার্সিটি প্রেস লিমিটেড, প্রকাশের তারিখ নেই, পৃষ্ঠা ১৬-১৭]
বস্তুত এভাবে বঙ্গবন্ধুর উক্তিতেও বাণীবদ্ধ হয়ে আছে আধাসামরিক বাহিনী ইপিআর (বর্তমান বিডিআর) ও পুলিশ বাহিনীর স্বাধীনতা যুদ্ধে আত্মত্যাগের কথাটি। আর সেদিন বঙ্গবন্ধুর বাণীও দেশবাসীর কাছে পৌছে দিয়েছিল এই আধাসামরিক বাহিনী। অত্যন্ত ঝুঁকির মধ্য দিয়ে সেদিন তারা দেশবাসীর কাছে বঙ্গবন্ধুর বাণী পৌছে দিয়ে এক ঐতিহাসিক ভূমিকা পালন করেছিল।
১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ রাতেই পাকিস্তানিদের বিরুদ্ধে সরাসরি প্রতিরােধ যুদ্ধে অংশ নিতে গিয়ে নিহত হয় অসংখ্য ছাত্র, পুলিশ, সেনাবাহিনীর নিয়মিত সদস্য এবং ইপিআর বাহিনীর বাঙালি স্বাধীনতাকামী সদস্যরা। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ইকবাল হল (জহুরুল হক হল), রাজারবাগ পুলিশ লাইন এবং পিলখানা ইপিআর সদর দপ্তরে এসব যুদ্ধ সংঘটিত হয়। পরদিন ২৬ ও ২৭ মার্চ সারা দিনই রাজধানী ঢাকা শহরে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে বাঙালি ছাত্র ও বাঙালি সৈনিকদের মধ্যে প্রকাশ্যে খণ্ডযুদ্ধ চলতে থাকে। ঢাকা সেনানিবাস থেকে বাঙালি লেফটেন্যান্ট আনােয়ার হােসেনের নেতৃত্বে তেজগাঁও ড্রাম ফ্যাক্টরির কাছে ইপিআর, আনসার, মুজাহিদ ও ছাত্র-শ্রমিকদের এক বিশাল দল সম্মিলিতভাবে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর ট্যাংক বাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধ চালিয়ে যায়। ১ এপ্রিল পর্যন্ত দলটি ঢাকা শহরে সক্রিয় ছিল। পরে এদের সবাই হয় নিহত অথবা গ্রেফতার হয়ে যায়। [মেজর রফিকুল ইসলাম বীর উত্তম, লক্ষ প্রাণের বিনিময়ে, পৃষ্ঠা ৩০-৩১)
এই ঘটনাগুলাের কথা উদ্ধৃত করা হচ্ছে এ জন্যে যে, এসব মুক্তিযােদ্ধার জন্য স্বাধীনতা অর্জনের লক্ষ্যে নতুন কোনাে ঘােষণা দিতে হয়নি, কারণ ঢাকা শহরে তখন সব ধরনের আন্তঃযােগাযােগ ব্যবস্থা ছিন্ন হয়ে গিয়েছিল। তারা বঙ্গবন্ধুর আগের নির্দেশ মােতাবেকই ‘একটি গুলি চললেই প্রতিরোধ যুদ্ধ শুরু হবে’ এই আহবানে উদ্দীপ্ত হয়ে তাৎক্ষণিকভাবে যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছিলেন।
ইপিআর-এর ওয়্যারলেসযােগে ২৫ মার্চ গভীর রাতে বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতার এই ঘোষণা কোন কোন ব্যক্তির মাধ্যমে সারা দেশে পাঠানাে হয়েছিল এবং ঘোষণাটি ওয়্যারলেসের মাধ্যমে পাঠানো হলে যারা সেদিন তা গ্রহণ করেছিলেন, তার বিবরণ ও তাদের নাম বাংলাদেশ সরকারের গণভবনে খােদাই করে লেখা ছিল। বঙ্গবন্ধুর প্রচুর ‘সাের্স’ ও গােপন যােগাযােগ সূত্র ছিল এবং সেটা থাকারই কথা। স্বাধীনতার প্রত্যক্ষ ঘােষণার বিষয়টি ছিল একটি গােপন বিষয়ও। শত্রুপক্ষের অগােচরে একান্ত ঘনিষ্ঠজন ছাড়া তিনি তা শেষ পর্যন্ত গােপন রাখতে সমর্থ হয়েছিলেন। যে যুদ্ধ ঘােষণাটি তিনি ২৫ মার্চ গভীর রাতে পাঠিয়েছিলেন, তিনি তা পাঠাতে চেয়েছিলেন পাকিস্তানিদের আক্রমণ শুরুর পর পরই। পাকিস্তান সেনাবাহিনীর তৎকালীন সামরিক কর্মকর্তাদের সাম্প্রতিককাল পর্যন্ত বিভিন্ন স্মৃতি গ্রন্থ থেকে এখন স্পষ্টতই বােঝা যাচ্ছে, পরিকল্পনা ছিল ২৬ মার্চ থেকে পাকিস্তানিরা বাঙালিদের ওপর আক্রমণ শুরু করবে। টিক্কা খানের পিআরও সিদ্দিক সালিক ও জেনারেল ফজল মুকিম খানের লেখা গ্রন্থ থেকে ব্যাপারটা স্পষ্টভাবে অনুধাবন করা যায় ।
কিন্তু আক্রমণটি আরাে একদিন এগিয়ে এনে ২৫ মার্চ রাত ১২টায় করা হয়। আবার ২৫ মার্চ রাত ১২টার একঘণ্টা আগেই অর্থাৎ রাত ১১টায়ই ক্যান্টনমেন্ট থেকে পাক সেনাবাহিনী বেরিয়ে পড়ে।
ফলে বাঙালিদের ওপর পাকবাহিনীর আক্রমণ পরিকল্পনার তারিখ ও সময় ঘন ঘন পরিবর্তন হওয়ায় বঙ্গবন্ধুর পাকবাহিনীর হামলা প্রতিরােধ সংক্রান্ত রণকৌশল কিছু কিছু ক্ষেত্রে হোঁচট খেয়েছে। তিনি তার ঘােষণা ও বার্তা রেখে যাওয়ার জন্যে যেসব সাের্স এ ওয়্যারলেস ব্যবহার করবেন ভেবেছিলেন, তার অন্তত দুটির সংবাদ পাওয়া যাচ্ছে, যা নিয়ে উৎকণ্ঠার অন্ত ছিল না।
[এসব উৎকণ্ঠার একটি ছিল প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রফেসর ড. নুরুল উলার, যিনি বঙ্গবন্ধুর নির্দেশে ওয়্যারলেস সেট তৈরি রেখেও শেষপর্যন্ত বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে ২৫ মার্চ রাতে যােগাযােগ করে উঠতে পারেননি। দ্বিতীয় উৎকন্ঠাটি এসেছিল ওয়ারির বলধা গার্ডেনে অবস্থিত একজন বাঙালি ইপিআর সদস্যের কাছ থেকে, যে ওয়্যারলেসটি শেষ পর্যন্ত বঙ্গবন্ধুর নির্দেশে বলধা গার্ডেনের পুকুরে নিরাপত্তার স্বার্থে ফেলে দেয়া হয়েছিল]।