অর্থনীতির ভোগসংক্রান্ত সাধারণ একটি পর্যবেক্ষণ হলো আয় বাড়লে জনসাধারণের খাদ্যাভ্যাসেবৈচিত্র্য আসে। এর সঙ্গে সঙ্গে প্রধান খাদ্যশস্যের মাথাপিছু ভোগ ও চাহিদাও কমতে থাকে।সরকারের হিসাব অনুযায়ী, দেশে মাথাপিছু আয় বাড়ছে। এর সঙ্গে সংগতি রেখে দেশে চালেরমাথাপিছু ভোগও কমছে বলে সর্বশেষ খানা আয়-ব্যয় জরিপে (২০১৬) উঠে এসেছে।
আবার কৃষি মন্ত্রণালয় থেকে বলা হচ্ছে দেশে চাল উৎপাদন বাড়ছে। চলতি ২০২১-২২ অর্থবছরেওচাল উৎপাদন বাড়ানোর লক্ষ্য রয়েছে মন্ত্রণালয়ের। অর্থনীতির ভোগপ্রবণতার তত্ত্ব অনুযায়ী, মন্ত্রণালয়ের পরিসংখ্যান সঠিক হলে দেশে চালের বাজার স্থিতিশীল থাকার কথা। যদিও বাজারেরপ্রকৃত চিত্র এর সম্পূর্ণ বিপরীত। ভরা মৌসুমেও অস্থিতিশীল হয়ে উঠছে চালের বাজারদর।
ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশের (টিসিবি) তথ্য অনুযায়ী, রাজধানীর বাজারে গতকাল সরুচালের সর্বনম্ন মূল্য ছিল প্রতি কেজি ৬৪ টাকা। এক মাস আগেও তা বিক্রি হয়েছে ৬০ টাকায়। একবছর আগে ছিল ৫৮ টাকা। সে হিসেবে গত এক মাসে বাজারে সরু চালের দাম বেড়েছে ৬ দশমিক২৫ শতাংশ। এক বছরে বেড়েছে ১০ দশমিক ৫৭ শতাংশ। বাজারে এখন মোটা চাল বিক্রি হচ্ছেকেজিপ্রতি ৪৮ টাকায়। এক মাস আগে তা বিক্রি হয়েছে ৪৪ টাকায়। এক বছর আগে ছিল ৪৫ টাকা।সে হিসেবে গত এক মাসে পণ্যটির দাম বেড়েছে ৮ দশমিক ৭ শতাংশ। এক বছরে বেড়েছে ৭দশমিক ৫৩ শতাংশ।
বাজারের এ অস্থিতিশীলতায় প্রশ্নবিদ্ধ হচ্ছে কৃষি মন্ত্রণালয়ের প্রকাশিত পরিসংখ্যানগুলো। বিশেষজ্ঞরাবলছেন, অর্থনীতির স্বাভাবিক গতিপ্রকৃতি অনুযায়ী এসব পরিসংখ্যান সঠিক হলে বাজারে অস্থিরতাদেখা দিত না। মন্ত্রণালয়ের উৎপাদন তথ্যে অবশ্যই অতিরঞ্জন বা গরমিল রয়েছে। চালসহ খাদ্যশস্যউৎপাদন নিয়ে কৃষি মন্ত্রণালয়ের তথ্যের সঙ্গে বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস) ও মার্কিনকৃষি বিভাগসহ (ইউএসডিএ) দেশী-বিদেশী সংস্থাগুলোর তথ্যে এখন উল্লেখযোগ্য মাত্রায় ব্যবধানদেখা যাচ্ছে। বিষয়টি এক পর্যায়ে কৃষি ও খাদ্যোৎপাদন খাতে বড় ধরনের ব্যবস্থাপনাগত সংকটেরকারণ হয়ে উঠছে।
বাংলাদেশ অর্থনৈতিক সমীক্ষার তথ্য অনুযায়ী, চলতি অর্থবছরে কৃষি মন্ত্রণালয় চাল উৎপাদনলক্ষ্যমাত্রা ধরেছে ৩ কোটি ৯৪ লাখ ৮১ হাজার টন। আবার ইউএসডিএর তথ্য অনুযায়ী, চলতি বছরদেশে চাল উৎপাদন হতে পারে ৩ কোটি ৫৮ লাখ ৫০ হাজার টন। গরমিল রয়েছে ২০২০-২১অর্থবছরের তথ্যেও। কৃষি মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুযায়ী, গত অর্থবছরে দেশে চাল উৎপাদন হয়েছে ৩কোটি ৯৮ লাখ ৩৭ হাজার টন। বিবিএসের তথ্যে এর পরিমাণ ৩ কোটি ৭৬ লাখ ৮ হাজার টন।আবার ইউএসডিএর পরিসংখ্যানে এর পরিমাণ ৩ কোটি ৪৬ লাখ টন।
কৃষি মন্ত্রণালয়ের তথ্য সঠিক হলে দেশে খাদ্যশস্য আমদানির প্রয়োজনই পড়ত না বলে মনেকরছেন অর্থনীতিবিদরা। বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক ড. আহসান এইচ মনসুর বণিক বার্তাকে বলেন, প্রতি বছরই চাল উৎপাদন নিয়েতথ্যের এ গরমিল আমরা দেখে আসছি। কৃষি মন্ত্রণালয়ের তথ্য যদি সঠিক হতো তবে চালআমদানির প্রয়োজন হতো না। তারা সঠিকভাবে যাচাই-বাছাইয়ের ভিত্তিতে এসব তথ্য দেয় না।এক্ষেত্রে বরং ইউএসডিএ স্যাটেলাইট ব্যবহার করে যে তথ্য দেয়, সেটি বেশি গ্রহণযোগ্য। সঠিকতথ্য না থাকায় তা দেশের কৃষি ও খাদ্য ব্যবস্থাপনায় সমস্যা তৈরি করছে। কারণ প্রথমে বলা হয়, আমরা চালে স্বয়ংসম্পূর্ণ। আমদানির প্রয়োজন নেই। পরে দেখা যায় চালের সংকট, ভোক্তাদের বেশিদাম দিয়ে কিনতে হচ্ছে। সে সময় তড়িঘড়ি করে অধিক মূল্যে চাল আমদানির অনুমতি দেয়া হয়।এতে হয়তো গুটি কয়েক ব্যবসায়ী লাভবান হচ্ছেন। তবে বরাবরের মতো ক্ষতিগ্রস্ত হতে হয় সাধারণভোক্তাদের।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, গত কয়েক বছরে দেশে চালের বাজার বারবার অস্থিতিশীল হয়ে উঠতে দেখাগিয়েছে। বিশেষ করে ২০১৮ সালের পর থেকে যৌক্তিক কারণ ছাড়াই চালের বাজার অস্থিতিশীলহয়ে ওঠার প্রবণতা দেখা যাচ্ছে বেশি। এক্ষেত্রেও সঠিক তথ্যের অভাব বড় ধরনের ভূমিকা রেখেছে।
বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (বিআইডিএস) সাবেক গবেষণা পরিচালক ও অর্থনীতিবিদড. এম আসাদুজ্জামান মনে করছেন, এ বিষয়ে বিবিএসের পরিসংখ্যান কৃষি মন্ত্রণালয়ের চেয়েঅনেক বেশি নির্ভরযোগ্য। বণিক বার্তাকে বলেন, বিবিএসের তথ্যগুলো অনেকটা বাড়ি বাড়ি গিয়েসংগ্রহ করা। আবার কৃষি মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা যে হিসাব দেন, তা সঠিকভাবে পরিমাপ করে দেননা। তাদের তথ্যে প্রায়ই দেখা যায়, বাস্তবতার চেয়ে বেশি জমিতে বেশি ফলন হয়েছে। এজন্যবিবিএসের তথ্যটিকেই তুলনামূলক বেশি গ্রহণযোগ্য বলা চলে। প্রকৃত তথ্য পেতে হলে কৃষিমন্ত্রণালয় ও বিবিএসকে যৌথভাবে হিসাব করতে হবে। কিন্তু সমস্যা হলো এ দুই সংস্থা ওমন্ত্রণালয়ের উৎপাদনের তথ্যে ব্যবধান অনেক বেশি। তথ্যে এত বেশি গরমিল থাকলে সঠিক নীতিপরিকল্পনা গ্রহণ করা যায় না। এর আগে বিআইডিএসও এ-সংক্রান্ত একটি জরিপ করেছিল।সেখানেও দেখা গিয়েছে, মন্ত্রণালয় থেকে উৎপাদনের যে তথ্য আসে, প্রকৃত উৎপাদন তার চেয়েঅনেক কম। চাহিদা স্থির থাকে। আবার উৎপাদনের তথ্যে গরমিল থাকায় সরবরাহও ঠিক থাকে না।ফলে বাজারে দেখা দেয় অস্থিতিশীলতা।
তিনি আরো বলেন, আগে কৃষি মন্ত্রণালয়ের তথ্যের নির্ভরযোগ্যতা ছিল বেশি। ওই সময়ে ক্রসকাটিংসার্ভে হতো। সেখান থেকে একটা গড় হিসাব পাওয়া যেত। মতিয়া চৌধুরী কৃষিমন্ত্রী থাকাকালেনিয়মিত স্যাটেলাইটভিত্তিক ছবি নিয়ে জরিপ করাতেন। এতে আবাদি জমির সঠিক পরিমাণ সম্পর্কেএকটা ধারণা পাওয়া যেত। এর সঙ্গে প্রকৃত তথ্যের সঙ্গে গরমিল থাকলেও তার মাত্রা হতো সামান্য।এখন দৈবচয়ন ভিত্তিতে ৬৪ জেলায় জরিপ হলেই হয়।
খাদ্যশস্যের উৎপাদন প্রবৃদ্ধিতে মন্থরতা দেখা যাচ্ছে কয়েক বছর ধরেই। চালের ক্ষেত্রে এ প্রবৃদ্ধিইতিবাচক হলেও নেতিবাচক গমে। আবার চাল উৎপাদন যতটুকু বাড়ছে, তা যথেষ্ট নয়। সাবেককৃষিমন্ত্রী মতিয়া চৌধুরীর আমলে গম উৎপাদন স্থিতিশীল থাকলেও বর্তমানে তা কমছে। বিষয়টিখাদ্যশস্যের আমদানিনির্ভরতা বৃদ্ধির ক্ষেত্রে বড় ধরনের ভূমিকা রাখছে।
মতিয়া চৌধুরী কৃষিমন্ত্রী থাকাকালে গত দশকের শুরুতে দেশে খাদ্যশস্যের আমদানিনির্ভরতার হারএক অংকে নেমে এসেছিল। গত দশকের মাঝামাঝি পর্যায়ে এসে তা কিছুটা বাড়তে শুরু করে।২০১৭ সালের আগাম বন্যায় হাওরের বোরো ধান নষ্ট হয়ে যাওয়ায় ২০১৬-১৭ অর্থবছরেউৎপাদনে বড় ধস নামে। এর পরিপ্রেক্ষিতে ওই অর্থবছর ও ২০১৭-১৮ সালে খাদ্যশস্য আমদানিব্যাপক মাত্রায় বেড়ে যায়। এর পরের অর্থবছরগুলোয় প্রকাশিত পরিসংখ্যানে দেশে খাদ্যশস্যউৎপাদন বৃদ্ধির কথা বলা হলেও আমদানিনির্ভরতাও ছিল অনেক। ২০১৮-১৯ অর্থবছরে দেশেখাদ্যশস্যের বাজারে আমদানিনির্ভরতার হার ছিল ১৫ দশমিক ৫৯ শতাংশ। পরের অর্থবছরে তাবেড়ে দাঁড়ায় ১৭ দশমিক ১০ শতাংশে। গত অর্থবছরে এর হার ছিল ১৭ দশমিক ৮০ শতাংশ।এভাবে চলতে থাকলে অদূরভবিষ্যতে আমদানিনির্ভরতার হার ২০ শতাংশ ছাড়িয়ে যাওয়ার আশঙ্কাকরছেন সংশ্লিষ্টরা। এরই মধ্যে ইউএসডিএর এক প্রক্ষেপণে বলা হয়েছে, আগামী অর্থবছরে দেশেখাদ্যশস্য আমদানির প্রয়োজন পড়তে পারে প্রায় এক কোটি টন।
এ বিষয়ে যোগাযোগ করা হলে সাবেক কৃষিমন্ত্রী মতিয়া চৌধুরী কোনো ধরনের মন্তব্য করতে রাজিহননি। বর্তমান কৃষিমন্ত্রী আব্দুর রাজ্জাকের সঙ্গে চেষ্টা করেও কথা বলা সম্ভব হয়নি।
বর্তমান প্রেক্ষাপটে তথ্যের গরমিল খাদ্য ব্যবস্থাপনায় বড় ধরনের সংকটের কারণ হয়ে উঠতে পারেবলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। তাদের ভাষ্যমতে, বিশ্বব্যাপী খাদ্য ও কৃষিপণ্যের সরবরাহ চেইনেবড় ধরনের ব্যাঘাত ঘটিয়েছে ইউক্রেন যুদ্ধ। এ মুহূর্তে আন্তর্জাতিক বাজারে কৃষি ও খাদ্যপণ্যের দামবাড়ছে। দেশের বাজারেও এর প্রভাব স্পষ্ট। এ মুহূর্তে কৃষি উৎপাদনের সঠিক তথ্য সামনে না এলেতা দেশের চালসহ কৃষি ও খাদ্যপণ্যের সার্বিক বাজার ব্যবস্থাপনাকে আরো কঠিন করে তুলবে। কৃষিউৎপাদনের সঠিক তথ্য না থাকায় কৃষক থেকে শুরু করে ভোক্তা পর্যন্ত সবাই ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন।একদিকে চাষীরা তাদের উৎপাদিত ধানের কাঙ্ক্ষিত মূল্য পাচ্ছেন না। অন্যদিকে নির্ভরযোগ্য তথ্যেরঅভাবে প্রয়োজন ও সময়মতো আমদানি হ্রাস-বৃদ্ধিসংক্রান্ত সঠিক সিদ্ধান্ত নেয়া সম্ভব হচ্ছে না। চালও গমসহ খাদ্যশস্যের বাজারে যখন-তখন অস্থিতিশীলতা সৃষ্টির সুযোগ পেয়ে যাচ্ছেনমধ্যস্বত্বভোগীরা।
অর্থনীতিবিদ ও সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) সম্মাননীয় ফেলো ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য এবিষয়ে বণিক বার্তাকে বলেন, সরকারি সংস্থা ও মন্ত্রণালয়ের তথ্যের এ পার্থক্য এখন আগেরতুলনায় বেড়েছে। গত বছর উৎপাদনের যে তথ্য দেয়া হয়েছিল তা বাস্তবতার সঙ্গে সাযুজ্যপূর্ণ ছিলনা। আবার কৃষি, খাদ্য ও বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের মধ্যে সমন্বয়হীনতার কারণে সময়মতো আমদানি করাযায়নি। এতে খাদ্য ব্যবস্থাপনা, সংগ্রহ, বিপণন ও আমদানি সবদিকই ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। সঠিক তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহের জন্য যে ধরনের নিষ্ঠা প্রয়োজন, তা এক্ষেত্রে পুরোপুরি অনুপস্থিত। তথ্যের নৈরাজ্যেরবড় উদাহরণ এটি। বিশ্বের সব জায়গায় যেভাবে মাঠ পর্যায়ের বিজ্ঞানভিত্তিক তথ্য সংগ্রহ পদ্ধতিপ্রচলিত, সেটিই অনুসরণ করা যেতে পারে। একাধিক পদ্ধতি ব্যবহার করে তুলনামূলক বিশ্লেষণেরমাধ্যমে আস্থাভাজন প্রাক্কলন করা প্রয়োজন। সঠিক তথ্য পাওয়া না গেলে চাহিদা জোগানের ক্ষেত্রেসমস্যা হয়। মৌসুমি ব্যবস্থাপনার ক্ষেত্রেও সমস্যা হয়। এতে কৃষক-ভোক্তা উভয়েই ক্ষতিগ্রস্ত হন।
সর্বশেষ গত মাসেও খাদ্য পরিকল্পনা ও পরিধারণ কমিটির (এফপিএমসি) সভায় বিভিন্ন সংস্থারমধ্যে উৎপাদনর তথ্যে গরমিল থাকার বিষয়টি উঠে আসে। ওই সময় উঠে আসে গত অর্থবছরেদেশে খাদ্যশস্য উৎপাদন নিয়ে বিবিএস ও কৃষি মন্ত্রণালয়ের তথ্যে গরমিলের পরিমাণ ৪০ লাখ ২০হাজার টন।
বিবিএসের তথ্যই বেশি নির্ভরযোগ্য বলে মনে করছেন পরিকল্পনা প্রতিমন্ত্রী ড. শামসুল আলম বলেন, বিবিএস পদ্ধতিগতভাবে সংগৃহীত তথ্যের ভিত্তিতেই কৃষির পরিসংখ্যানপ্রকাশ করে। সংস্থাটির কাছ থেকে পাওয়া তথ্যকেই নির্ভরযোগ্য বলে ধরে নিতে হবে।