” বাংলা ভাষার উৎপত্তি,
ইতিহাস ও বিবর্তন “
নিউজ ডেস্ক আদালত বার্তাঃ২৮ ফেব্রুয়ারি ২০২৪।
আমরা প্রতিদিন যে ভাষায় মনের ভাব প্রকাশ করে চলেছি, তার উৎপত্তি আর ইতিহাস নিয়ে কখনো ভেবে দেখেছি কি! কয়েক হাজার বছর আগে কেমন ছিলো এই ‘বাংলা ভাষা’? কিভাবে জন্ম হলো এই ভাষার? কিভাবেই বা হাজার বছর ধরে বেড়ে উঠেছে আমাদের প্রাণের ভাষা?
যতদূর জানা যায়, বাংলা ভাষা হচ্ছে ইন্দো-ইউরোপিয়ান ভাষাবংশের সদস্য। যার উৎপত্তি আজ থেকে প্রায় সাত হাজার বছর আগে খ্রিস্টপূর্ব ৫০০০ অব্দে! খ্রিস্টপূর্ব ৩৫০০ অব্দে এই ইন্দো-ইউরোপিয়ান ভাষাবংশ থেকে জন্ম নেয় ‘শতম’। এর প্রায় এক হাজার বছর পর খ্রিস্টপূর্ব ২৫০০ অব্দে ‘শতম’ ভাষাটি রুপান্তরিত হয় ‘আর্য’ ভাষায়। তবে তখন পর্যন্ত উপমহাদেশে আর্য ভাষার চল হয়ে ওঠেনি। ভারত উপমহাদেশে আর্য ভাষার চল শুরু হয় খ্রিস্টপূর্ব ১৮০০ অব্দে আর্য জাতি আগমনের পর।
আর্যদের শাসন করা কালীন, ভারতীয় আর্য ভাষা শিখে নিল। তখন ভাষাটি হয়ে গেল “ভারতীয় আর্য” ভাষা। ভারতীয় আর্যভাষা টি ভারতে ভাষার একটি রূপ। তখন সবাই “ভারতীয় আর্য” ভাষার কথা বলতে শুরু করে দিল।
পরবর্তীতে কথা বলা এবং লেখা দুটো আলাদা হয়ে গেল। অঞ্চল ভিত্তিতে যে ভাষায় কথা বলা হত তাকে তাকে মুখের ভাষা বলা হয়, বইয়ের ভাষায় যাকে বলে “প্রাকৃত” ভাষা।
তৎকালীন লিখিত ভাষার নাম ছিল “সংস্কৃত”। ভাষাবিজ্ঞানের বিচারে বলা চলে যে সংস্কৃত তথা প্রাচীন ভারতীয় আর্যভাষা প্রাকৃতের তথা মধ্যভারতীয় আর্যভাষার অন্ততঃ তিনটি স্তরের মধ্য দিয়ে ক্রমবিবর্তিত হতে হতে আনুমানিক খ্রীঃ দশম শতকের দিকে বাঙলা এবং অপরাপর আঞ্চলিক নব্য ভারতীয় আর্যভাষায় রূপান্তরিত হয়। কাজেই ‘বাঙলা ভাষার জননী’ বলতে মধ্যভারতীয় আর্যভাষা বা ‘প্রাকৃ ভাষা’কেই বুঝিয়ে থাকে, কারণ এই ভাষা থেকেই সরাসরি বাংলা ভাষার উদ্ভব ঘটেছে।
বাঙলা ভাষা হাজার বছরে অনেকখানি পরিবর্তিত হওয়ায় ভাষায় পরিবর্তন অনুযায়ী তাকে আদিযুগ, আদিমধ্যযুগ, অন্ত্যমধ্যযুগ ও আধুনিক যুগ এই চারটি পর্বে বিভক্ত করা হয়। প্রতি পর্বেই ভাষাগত পরিবর্তন লক্ষণীয়।
বাঙলা ভাষার প্রাচীনতম নিদর্শন ‘চর্যাপদ’- আনুমানিক খ্রীঃ দশম থেকে দ্বাদশ শতকের মধ্যে রচিত হয়। এই কালটিকে বলা হয় বাঙলা ভাষা ও সাহিত্যের ‘আদিযুগ’। বৌদ্ধ সিদ্ধাচার্যগণ সদ্য-উদ্ভূত বাঙলা তাঁদের সাধন-ভজন-বিষয়ক তদ্বাদি এই গ্রন্থে বিভিন্ন পদের আকারে রচনা করেছিলেন। চর্যাপদ ধর্মীয় সাহিত্য। খ্রীঃ ত্রয়ােদশ থেকে চতুর্দশ শতাব্দীর অর্ধাংশ পর্যন্ত ছিল ক্রান্তিকাল। একালে রচিত কোন রচনার নিদর্শন সুলভ নয়। এরপর ১৩৫০ খ্রীঃ থেকে ১৪০০ খ্রীঃ পর্যন্ত বাঙলা ভাষা ও সাহিত্যের মধ্যযুগ। এর মধ্যে আবার ১৫০০ খ্রীঃ পর্যন্ত আদিমধ্যযুগ বা চৈতন্য-পূর্ব যুগ। এই যুগের উল্লেখযােগ্য সাহিত্য বড়ু চণ্ডীদাস রচিত শ্রীকৃষ্ণকীর্তন’, বিদ্যাপতির বৈষ্ণব পদাবলী কিছু অনুবাদ সাহিত্য এবং কয়টি প্রধান মনসামঙ্গল কাব্য। চৈতন্যদেবের আবির্ভাব বাঙলার সাহিত্যে ও সমাজে প্রচণ্ড প্রভাব বিস্তার করে। ফলে, বাঙলা ভাষা ও সাহিত্যের গুণগত এবং পরিমাণগত পরিবর্তন সাধিত হয়েছিল অনেকখানি। অন্ত্যমধ্যযুগে তথা চৈতন্যোত্তর যুগে জীবনী সাহিত্য, পদাবলী সাহিত্য, অনুবাদ সাহিত্য, বিভিন্ন ধারার মঙ্গলকাব্য ও নানাজাতীয় লােক সাহিত্যের সৃষ্টি হয় (১৮০০ খ্রীঃ ফোর্ট উইলিয়াম কলেজের প্রতিষ্ঠার সঙ্গে সঙ্গে গদ্য-সাহিত্যের উদ্ভব এবং তার পরই পাশ্চাত্ত্য জ্ঞানবিজ্ঞানের প্রত্যক্ষ প্রভাবে বাঙলা সাহিত্যে যে বিপুল পরিবর্তন সাধিত হয়, তাকেই বলা হয় ‘আধুনিক যুগ’। বাঙলা ভাষা ও সাহিত্যের যুগ বিভক্ত বিভিন্ন পর্যায়ে ভাষাও যুগােপযােগীভাবে পরিবর্তিত হয়েছে।
মুখের ভাষা অর্থ প্রাকৃত ভাষা কে আবার দুই ভাগে ভাগ করা হলো গৌড় অঞ্চলের যে ভাষায় কথা বলা হত তাকে বলা হল “গৌড়ীয় প্রাকৃত” এবং মগধ নামে যে এলাকা ছিল তারা যে ভাষায় কথা বলতো সেটির নাম ছিল “মাগধী প্রাকৃত”।
সুনীতিকুমারের মতে বাংলা ভাষা এসেছে “মাগধী প্রাকৃত” থেকে দশম শতাব্দীতে। “গৌড়ীয় প্রাকৃত” থেকে বাংলা ভাষায় এসেছে সপ্তম শতাব্দীতে, এটি বলেছেন ডঃ মুহাম্মদ শহীদুল্লাহ। বাংলা ব্যাকরণে সুনীতিকুমারের কথাকে কে বেশি প্রাধান্য দেওয়া হয়।
সুনীতিকুমারের মতে “মাগধী প্রাকৃত” হোক বা মোহাম্মদ শহীদুল্লাহর মতে “গৌড়ীয় প্রাকৃত” একসময় এই ভাষাটি বিকৃতি হয়ে যায়। ভাষা যখন ব্যর্থ হয় তখন সেটাকে বলা হয় “অপভ্রংশ”। এই বিকৃতি ভাষা থেকে সরাসরি একটি ভাষার উৎপন্ন হয় “বঙ্গকামরূপী”। “বঙ্গকামরূপী” যেটি “অপভ্রংশের” একটি রূপ। এখান থেকে সরাসরি কিছু ভাষা তৈরি হয় তার মধ্যে অন্যতম হচ্ছে বাংলা, এরমধ্যে আবার আছে অসমীয়া যেটা বর্তমানে আসামের ভাষা, আরো আছে উড়িয়া ভাষা যেটা উড়িষ্যাতে কথা বলা হয়।
উপমহাদেশে আর্য ভাষা চালু হবার পরবর্তী তিনশো বছরে পরিবর্তনের উপমহাদেশীয় হাওয়া লাগে আর্য ভাষায়। প্রচুর পরিমাণ সংস্কৃত ভাষার শব্দ যোগ হয়ে আর্য ভাষা রুপ নেয় ‘প্রাচীন ভারতীয় আর্য’ ভাষায় (খ্রিস্টপূর্ব ১৫০০ অব্দ)। আর্য জাতির পাশাপাশি ধীরে ধীরে উপমহাদেশর সাধারণ মানুষও আপন করে নেয় এই প্রাচীন ভারতীয় আর্য ভাষা। তখন আরো কিছুটা রুপান্তরিত হয়ে এ ভাষা হয়ে ওঠে ‘প্রাচীন ভারতীয় আর্য কথ্য’ ভাষায় (খ্রিস্টপূর্ব ১০০০ অব্দ) যা ‘আদিম প্রাকৃত’ নামেও পরিচিত। এরপর খ্রিস্টপূর্ব ৮০০ অব্দ হতে ৪৫০ খ্রিস্টাব্দের মধ্যবর্তী সময়ে আদিম প্রাকৃতের রুপান্তর ঘটে প্রথমে ‘প্রাচীন প্রাচ্য প্রাকৃত’ এবং পরবর্তীতে ‘গৌড়ি প্রাকৃত’ ভাষা দুটির উৎপত্তি হয়। আর এই গৌড়ি প্রাকৃত থেকে ৪৫০ খ্রিস্টাব্দের কাছাকাছি সময়ে জন্ম হয় ‘গৌড়ি অপভ্রংশ’ ভাষার।
এই গৌড়ি অপভ্রংশ থেকেই ৯০০ খ্রিস্টাব্দের দিকে উৎপত্তি হয় ‘বাংলা’ ভাষার । শুরুর দিকে অবশ্য বাংলা ভাষা ঠিক শতভাগ এমন ছিল না। ভাষাবিদগণের ভাষায় সে সময়ের বাংলা কে বলা হয় ‘প্রাচীন বাংলা’। এরপর ১৪০০ খ্রিস্টাব্দের দিকে আসে ‘মধ্য বাংলা’ এবং ১৮০০ খ্রিস্টাব্দের দিকে সেটা রুপ নেয় ‘আধুনিক বাংলা’ ভাষায়। অর্থাৎ, যে ভাষায় আমরা এখন কথা বলি।
এই আধুনিক বাংলা ভাষার জন্যেই ১৯৫২ সালের আজকের এই দিনে প্রাণ দিয়েছিলেন বাংলার সূর্য-সন্তান রফিক, বরকত, আব্দুস সালাম, আব্দুল জব্বারেরা। যা আমাদের সবারই জানা। তবে অনেকেই যেটা জানেন না তা হলো, বাংলা ভাষার জন্য শুধু বাংলাদেশিরা নয় আন্দোলন করেছেন দেশের বাইরের অনেক মানুষই। পঞ্চাশ এর দশকে ভারতের বিহার রাজ্যের (এরাও বাঙালি) মানভূম জেলায়ও হয় বাংলা ভাষার জন্য আন্দোলন। ১৯৬১ সালে আমাদের দেশে হয়ে যাওয়া ভাষা আন্দোলনের জের ধরে ভারতের শিলচরে বাংলা ভাষার আন্দোলনে ১১ জন শহীদ হন।
পরবর্তীতে ১৯৯৯ সালের ১৭ মে ইউনেস্কো আমাদের ভাষা এবং ভাষা শহীদদের সম্মানে ‘একুশে ফেব্রুয়ারি’ কে আন্তর্জাতিক মার্তৃভাষা দিবসের মর্যাদা দেয়। শুধু তাই নয় আফ্রিকা মহাদেশের সিয়েরা লিওন নামের দেশটিও সম্প্রতি বাংলা কে তাদের রাষ্ট্রভাষার মর্যাদা দিয়ে। পুরো পৃথিবীজুড়ে প্রায় বিশ কোটির বেশি মানুষ বাংলায় কথা বলে। ভাষাভাষী লোকসংখ্যার দিক থেকে পৃথিবীর সপ্তম এবং একই সাথে তিনটি দেশের রাষ্ট্রভাষা ‘‘আমাদের প্রাণের বাংলা’’ !
newskotha, Wikipedia millionconten