পৃথক ফৌজদারি ও পারিবারিক আদালত প্রতিষ্ঠা হচ্ছে
পদসৃজন হচ্ছে সাত শতাধিক
নিউজ ডেস্ক আদালত বার্তাঃ ১৬ সেপ্টেম্বর, ২০২৫
প্রথমবারের মতো পৃথক দায়রা (ফৌজদারি) ও পারিবারিক আদালত প্রতিষ্ঠা করছে সরকার। এজন্য সাত শতাধিক বিচারকের পদসৃজনও করা হয়েছে। এর মধ্যে অতিরিক্ত দায়রা আদালতের জন্য ২০৩টি ও যুগ্ম দায়রা আদালতের জন্য ৩৬৭টি বিচারকের পদসৃজন করা হয়েছে। এ ছাড়া পারিবারিক আদালতের পদসৃজন করা হয়েছে ১৬৩টি।
আজ মঙ্গলবার (১৬ সেপ্টেম্বর) এ বিষয়ে প্রজ্ঞাপন জারি করতে পারে আইন, বিচার ও সংসদবিষয়ক মন্ত্রণালয়। সরকারের এ পদক্ষেপের ফলে বিচার কাজে গতি আসবে ও মামলার জট কমবে। পাশাপাশি বিচার প্রার্থীদের ভোগান্তি কমবে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।
দেশে বর্তমানে ৪৫ লাখের বেশি মামলা বিচারাধীন। এর বিপরীতে বিচারক রয়েছেন মাত্র ২ হাজারের মতো। জনসংখ্যা ও মামলার অনুপাতে প্রয়োজনের তুলনায় বিচারকের এ সংখ্যা খুবই কম। ফলে ভারপ্রাপ্ত আদালতের ভারে কাবু বিচারকরা। একজন বিচারককে একই সঙ্গে ফৌজদারি ও দেওয়ানি মামলার বিচার করতে হয়। পাশাপাশি বিভিন্ন ট্রাইব্যুনাল ও আদালতের ভারপ্রাপ্ত দায়িত্বও পালন করেন। এতে বিচারকাজ গতি হারায়। বেড়েই চলে মামলার জট।
আইনে আদালত পৃথক করার বাধ্যবাধকতা
জানা গেছে, দেওয়ানি মামলা বিচারের জন্য ‘দ্যা সিভিল কোর্টস অ্যাক্ট-১৮৮৭’-এর ৩ ধারায় জেলা জজ আদালত, অতিরিক্ত জেলা জজ আদালত, যুগ্ম জেলা জজ আদালত, সিনিয়র সহকারী জজ আদালত এবং সহকারী জজ আদালত স্থাপনের কথা বলা হয়েছে। এ ছাড়া ফৌজদারি মামলা বিচারের জন্য ‘দ্যা কোড অব ক্রিমিনাল প্রসিডিউর ১৮৯৮’-এর ৯ ধারায় দায়রা আদালত, অতিরিক্ত দায়রা আদালত, যুগ্ম দায়রা আদালত প্রতিষ্ঠার কথা বলা হয়েছে। দেওয়ানি ও ফৌজদারি মামলা বিচারের জন্য পৃথক পৃথক আদালত স্থাপনের উদ্দেশ্য আইনেই স্পষ্ট রয়েছে।
তারপরও যুগের পর যুগ অধস্তন আদালতের বিচারকদের একসঙ্গে ফৌজদারি ও দেওয়ানি মামলার বিচার করতে হয়। এ ছাড়া পারিবারিক আদালত আইনেও পৃথক পারিবারিক আদালত স্থাপনের কথা বলা হয়েছে। কিন্তু সহকারী জজ ও সিনিয়র সহকারী জজ আদালতগুলো পারিবারিক আদালতের অতিরিক্ত দায়িত্ব পালন করে থাকেন।
মামলার জটের চিত্র
আদালতে মামলার জট সীমাহীন পর্যায়ে পৌঁছেছে। গত মে পর্যন্ত অতিরিক্ত জেলা ও দায়রা জজ আদালতগুলোতে ৩৪ হাজার ৩৪২টি দেওয়ানি এবং ১ লাখ ৭৫ হাজার ৮৭২টি ফৌজদারি মামলা বিচারাধীন ছিল। অতিরিক্ত জেলা ও দায়রা জজ, জেলা ও দায়রা জজের সমপর্যায়ের বিচারিক ক্ষমতা প্রয়োগ করেন। হত্যা, খুন, ধর্ষণসহ ফৌজদারি সব অপরাধের বিচারের পাশাপাশি দেওয়ানি মামলারও বিচার করে থাকেন।
অন্যদিকে, গত মে পর্যন্ত যুগ্ম জেলা ও দায়রা জজ আদালতে ১ লাখ ৮২ হাজার ৮৩২টি দেওয়ানি এবং ৩ লাখ ৫৫৭টি ফৌজদারি মামলা বিচারাধীন ছিল। যুগ্ম জেলা ও দায়রা জজ আদালতের কাজ হলো জেলা জজের অধীনে থাকা দেওয়ানি ও ফৌজদারি আদালতের বিচারিক প্রক্রিয়া পরিচালনা করা এবং নির্দিষ্ট পরিমাণ আর্থিক অঙ্কের বা গুরুতর অপরাধের মামলাগুলো নিষ্পত্তি করা। বর্তমানে যুগ্ম জেলা ও দায়রা জজ আদালত এবং অতিরিক্ত জেলা ও দায়রা জজ আদালতে মোট ৭ লাখের ওপরে মামলা বিচারাধীন।
পাশাপাশি দেশে সহকারী জজ বা সিনিয়র সহকারী জজ আদালতগুলোতে ৯ লাখ ১৩ হাজার ৪৪৯টি দেওয়ানি ও ১ লাখ ১৯ হাজার ৮৩০টি পারিবারিক মামলা বিচারাধীন। পারিবারিক আদালত আইন, ২০২৩-এর ৪ ধারায় প্রতিটি জেলায় এক বা একাধিক স্বতন্ত্র পারিবারিক আদালত প্রতিষ্ঠার বাধ্যবাধকতা রয়েছে। এ আদালতগুলোকে বিবাহ, বিবাহবিচ্ছেদ, সন্তান ও স্ত্রীর ভরণপোষণ, অভিভাবকত্ব এবং সন্তানের হেফাজত সম্পর্কিত বিষয়গুলো দ্রুত নিষ্পত্তির জন্য কাজ করে। কিন্তু আইনি বাধ্যবাধকতা সত্ত্বেও দেশে কোনো পারিবারিক আদালত প্রতিষ্ঠা করা হয়নি।
সুপ্রিম কোর্টের উদ্যোগ ও সরকারের পদক্ষেপ
দেওয়ানি আদালতগুলোতে বিচারাধীন বিপুলসংখ্যক মামলার বিচারের পাশাপাশি সহকারী জজ বা সিনিয়র সহকারী জজ আদালতগুলোকে অতিরিক্ত দায়িত্ব হিসেবে পারিবারিক আদালতের মামলা নিষ্পত্তি করতে হচ্ছে। ফলে, দেওয়ানি মামলার বিচার যেমন বিলম্ব হচ্ছে, তেমনি পারিবারিক আদালতে বিচারাধীন মামলাগুলো গুরুত্বসহকারে নিষ্পত্তি করা সম্ভব হচ্ছে না। এসব কারণে বিচার প্রার্থীদের দুর্ভোগ কমানো ও ন্যায়বিচার বাধাগ্রস্ত হচ্ছে।
বিষয়টি লক্ষ করে গত ২১ এপ্রিল আইন মন্ত্রণালয়কে চিঠি দেয় সুপ্রিম কোর্ট প্রশাসন। চিঠিতে বলা হয়, অধস্তন আদালতগুলোতে বর্তমানে যুগ্ম জেলা ও দায়রা জজ, অতিরিক্ত জেলা ও দায়রা জজ এবং জেলা ও দায়রা জজ দেওয়ানি আপিল, দেওয়ানি রিভিশন, ফৌজদারি আপিল, ফৌজদারি রিভিশনের পাশাপাশি বিভিন্ন বিশেষ আদালত ও ট্রাইব্যুনালের বিচারক হিসেবে মামলা পরিচালনার দায়িত্ব পালন করে যাচ্ছেন। এর ফলে বিচারকদের সদিচ্ছা থাকা সত্ত্বেও প্রত্যাশিত সংখ্যক মামলা নিষ্পত্তি করা সম্ভব হচ্ছে না। এতে মামলার জট দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। বিশেষ করে দেওয়ানি মামলার ক্ষেত্রে দীর্ঘসূত্রতার সৃষ্টি হচ্ছে।
চিঠিতে আরও বলা হয়, পৃথক এখতিয়ার প্রয়োগের সুবিধার্থে এবং মামলাজট নিরসনের জন্য বিচার বিভাগের সাংগঠনিক কাঠামো পরিবর্তন করে পৃথক আদালত স্থাপন ও দরকারি সংখ্যক পদ সৃষ্টি করা প্রয়োজন। মামলার দ্রুত ও সুষ্ঠু বিচার নিশ্চিতকরণের লক্ষ্যে দেওয়ানি ও ফৌজদারি এখতিয়ার অনুসারে জেলা জজশিপ ও সেশনস ডিভিশন পৃথককরণ এবং সংশ্লিষ্ট জজশিপ ও সেশনস ডিভিশনের সাংগঠনিক কাঠামো পরিবর্তন করে প্রয়োজনীয় সংখ্যক পদ সৃষ্টির জন্য প্রধান বিচারপতি নির্দেশনা দিয়েছেন। তাই এ বিষয়ে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণের জন্য ‘নির্দেশক্রমে অনুরোধ’ করা হলো।
প্রধান বিচারপতির এ চিঠির পাশাপাশি বর্তমান আইন উপদেষ্টার সক্রিয় ভূমিকার কারণে দায়রা আদালতের পাশাপাশি পৃথক পারিবারিক আদালত স্থাপন ও পদসৃজনের কাজেও গতি পায়। এ ছাড়া বিচার বিভাগ সংস্কার কমিশনের প্রতিবেদনে প্রতি ৮০০ মামলার বিপরীতে একজন বিচারক প্রয়োজন-মর্মে সুপারিশ করা হয়েছে। সেই সুপারিশ আমলে নিয়ে দ্রুতই পদক্ষেপ নেয় আইন মন্ত্রণালয়।
বিশেষজ্ঞ মতামত
অবসরপ্রাপ্ত সিনিয়র জেলা ও দায়রা জজ ড. শাহজাহান সাজু বলেন, ‘পৃথক ফৌজদারি ও দেওয়ানি আদালত এবং পৃথক পারিবারিক আদালত স্থাপনে আইনি বাধ্যবাধকতা রয়েছে।